মোহাম্মদ ইব্রাহিম: বিশ্বের বৃহত্তম ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্রের স্রষ্টা

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১ জানুয়ারি ১৯১১—৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯)

বাংলাদেশ সেই আদিকাল থেকেই নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির আধার। খাল–বিল নদী–নালায় পূর্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই অঞ্চলে এককালে ওলা ওঠা (কলেরা), ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্তে উজাড় হয়ে যেত গাঁয়ের পর গাঁ। এ দেশের মানুষের মূল শত্রুই ছিল সংক্রামক ব্যাধি। এ রকম একটা দেশে সেই পঞ্চাশের দশকে অসংক্রামক ব্যাধির গুরুত্ব অনুধাবন করাটা যথেষ্ট অবাক করার মতোই বিষয়।

কিন্তু সেই সময় এ দেশের একজন দূরদর্শী চিকিৎসক সে কথা ভেবেছিলেন। ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ যে একদিন এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, কয়েক দশক পরই যে এই দেশ হয়ে উঠবে বিশ্বে সবচেয়ে ডায়াবেটিস–বহুল জনসংখ্যার একেবারে প্রথম দিককার সদস্য, এমন একটা আশঙ্কার কথা সেদিন শুধু এ দেশে কেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই অনুমান করতে পারেনি। অথচ সময়ের সঙ্গে সেটিই সত্য হয়েছে।

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রয়ারি সেগুনবাগিচায় নিজের বাড়িতে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে জনাব নোমানী, জনাব সলিমুল্লাহ ফাহমী, মিসেস দোহানী প্রমুখ সমাজসেবীকে নিয়ে দূরদর্শী ও অসামান্য এই ব্যক্তি গঠন করলেন পাকিস্তান (স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ) ডায়াবেটিস সমিতি। সমিতির প্রেসিডেন্ট ডা. দবিরউদ্দিন নিজেও একজন ডায়াবেটিসের রোগী।

মাত্র ৩৮০ বর্গফুট জায়গায় দেশে প্রথমবারের মতো শুরু হলো ডায়াবেটিস চিকিৎসা। এটা সেই সময়ের কথা, যখন এ রোগ সম্পর্কে সমাজে কোনো সচেতনতা ছিল না। ছিল না কোনো তহবিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা অন্য কোনো সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা; বরং ডায়াবেটিস নিয়ে লোকের মনে ছিল আতঙ্ক ও কুসংস্কার। ইনসুলিন নিয়ে ভীতি। শোনা যায়, চিকিৎসার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডায়াবেটিসের রোগীদের ধরে আনতেন ডা. ইব্রাহিম।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে যখন দেখেন, তিল তিল করে গড়ে তোলা ডায়াবেটিক হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র বিভিন্ন সংস্থায় স্থানান্তর হয়ে গেছে, তখনো ভেঙে পড়েননি ডা. ইব্রাহিম। কয়েক মাসের মধ্যে আবার গড়ে তোলেন ডায়াবেটিক সমিতি। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক সভাপতি আলমগীর এম এ কবীর তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘সবার আগে অফিসে আসতেন ডা. ইব্রাহিম। প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও প্রতিটি শাখা ঘুরে দেখতেন। কোথাও একটি পিন বা তুলা পড়ে থাকলে নিজের হাতে তুলতেন। আয়া থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মীর সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন। বন্ধের দিনেও বাসায় থাকতেন না। উৎসবের দিনে হাসপাতালের রোগীদের একবার না দেখে উৎসবে যোগ দিতেন না।’

মোহাম্মদ ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ১৯৫৬ সালে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে শুরু হয়েছিল যার যাত্রা
ছবি: প্রথম আলো

একসময় বিশাল আকার ধারণ করে সেই সমিতি। আর এখন সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বৃহত্তম অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। শাহবাগে বিশালায়তন বারডেম হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, শ্যামলীতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্স (বিইউএইচএস), ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং কলেজসহ সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্কের ১৬টি ডায়াবেটিস সেন্টারের মাধ্যমে ৭০ বছর ধরে এ দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি। দিনে দিনে সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় একটি মডেলে পরিণত হয়েছে এই নেটওয়ার্ক ও চিকিৎসাপদ্ধতি। আর এই বৃহৎ স্বপ্নের কারিগর হচ্ছেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম।

১৯১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর ইউনিয়নের খাঁড়েরা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৩৮ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে মেডিকেল গ্র্যাজুয়েশন বা এমবি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তারপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হাউস ফিজিশিয়ান, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার এবং পরে রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে চট্টগ্রামে সিভিল সার্জন পদে যোগদান করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। বিলেতে এমআরসিপি করে ১৯৫০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন।

পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যাঁরা ডা. ইব্রাহিমের ছাত্র বা সহকর্মী ছিলেন, তাঁরা সবাই তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাদানপদ্ধতি, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং অমায়িক ব্যবহারের কথা স্মরণ করেন। কিন্তু জগতে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজ ক্যারিয়ার, চাকরি বা ব্যক্তিগত অভিলাষের বাইরে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে জানেন, হয়ে ওঠেন ত্রিকালদর্শী সংগঠক ও সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি—মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন সে রকম একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ সালে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডা. হোমায়রা সাঈদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি। যে সময় দেশে জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ) বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা বা পরিকল্পনাই গড়ে ওঠেনি, তখনই তিনি এসব নিয়ে ভেবেছিলেন।

একই সঙ্গে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস বিষয়েও বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন ডা. ইব্রাহিম। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন, যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের ভোগান্তি যেমন বেশি, তেমনি তাঁদের কোনো রোগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও তত কম। তখনই তিনি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে আগামী বিশ্বে ভয়াবহতম রোগ হয়ে দেখা দেবে ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক নীরব ঘাতক ব্যাধি।

ডা. ইব্রাহিম যে ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা ছিলেন, তার আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। আলমা আতায় ১৯৭৮ সালে প্রাথমিক পরিচর্যা সম্পর্কে যে আটটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং সামাজিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, তারও ১০ বছর আগে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি আধা শহর এলাকায় ওই বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়ে একটি প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ডায়াবেটিস রোগের ‘সার্বিক সেবা’য় বিশ্বাস করতেন। তাই কেবল চিকিৎসা নয়, রোগীর পুনর্বাসন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, এপিডেমিওলজি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা—সবদিকেই ছিল তাঁর আগ্রহ। রোগীর তথ্য–উপাত্তের সঠিক সংরক্ষণ যে একটা জরুরি বিষয়, যা তখনকার বাংলাদেশে কেউ চিন্তাই করতে পারেননি, সেটিও তিনি ভেবেছিলেন।

একটি লেখায় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণ করেছেন, ‘আশির দশকের প্রথম দিকে সারা দেশে মুষ্টিমেয় যে কয়টি কম্পিউটার ছিল, তার একটি ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক। এ সময় ডা. ওয়াহীদ উদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে ডা. ইব্রাহিম যোগাযোগ করেন। উদ্দেশ্য—কীভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করে ডায়াবেটিক রোগীদের উপাত্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং তথ্য বিশ্লেষণ করা যায়। ডা. ইব্রাহিম তখন বহির্বিভাগের শেলফে রক্ষিত সারি সারি বাঁধানো বই বের করে ফরমের প্রতিটি তথ্য ব্যাখ্যা করে জানতে চাইলেন, এসব তথ্য সংরক্ষণের সমস্যা সমাধানে কীভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করা যেতে পারে।’ সবাই জানেন যে চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রেও বারডেম হাসপাতাল এ দেশে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে।

প্রতিদিন সারা দেশ থেকে তিন হাজারের বেশি রোগী বারডেমের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসে। এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান—যেমন বিভিন্ন সেন্টার, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, মিরপুর বিআইএইচএসের হিসাব এখানে ধরা হয়নি।

জীবনে বহু কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সভাপতি, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের সহসভাপতি, ১৯৭৫-৭৭ সময়কালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা, ১৯৮১ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর মূল ধ্যানজ্ঞান ছিল বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি এবং এর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বারডেম।

এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মডেল এবং বিশ্বের বৃহত্তম ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে আজ স্বীকৃত। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিজ বাসভবনে মারা যান এই মহান ব্যক্তি। তবে সগৌরবে টিকে আছে তাঁর কীর্তি বারডেম।

১৯৭৮ সালে ফিজিওলজি নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান এবং সুইডেনের ক্যারোলিনস্ক ইনস্টিটিউটের প্রধান অধ্যাপক ডা রলফ লুফৎ বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কর্মকাণ্ড দেখতে এসে অবাক হন। পরে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনো অংশে এটা মিরাকলের চেয়ে কম নয়।

উন্নয়নশীল যেসব দেশে আমি গিয়েছি, এমনকি বাংলাদেশের চেয়েও যারা উন্নত, তাদের সঙ্গেও আপনার এই প্রতিষ্ঠানকে মেলানো যায় না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনার মতো মানুষ পৃথিবীতে আছেন, না হলে দুনিয়াটা অসহ্য হয়ে উঠত।’

  • তানজিনা হোসেন: হরমোন ও ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ; সহযোগী অধ্যাপক, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল