কে এ এস মুর্শিদ

দেশের কৃষির অর্জন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ধান-সবজি থেকে শুরু করে মাছ ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সফলতার সুফল আমরা ভালোই পেয়েছি। এত দিন আসলে আমরা সবুজ বিপ্লবের সময়ে যে কৃষিপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনগুলো হয়েছে, তার সুফল ভোগ করেছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সবুজ বিপ্লবের এ সাফল্যের পর কৃষিতে আমূল পরিবর্তন করার মতো প্রযুক্তি খুব একটা আসেনি। হাইব্রিড ধান ও সবজির মাধ্যমে কিছুটা উৎপাদন বাড়লেও আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর সঙ্গে তা তাল মেলাতে পারছে না। 

ফলে দেশের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, এত দিন আমরা কৃষি বলতে শুধু ধান-চাল বুঝতাম। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, মধ্যবিত্তের আকার বড় হয়েছে। প্রবাসী আয়ের কারণে দেশের গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের ধরনে বদল হয়েছে। তাদের খাদ্যতালিকায় ভোজ্যতেল, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিমসহ নানা ধরনের আমদানিনির্ভর খাদ্য বাড়ছে। ফলে এসব খাদ্যের আমদানিও আমাদের বাড়াতে হচ্ছে। যে কারণে আমাদের কৃষি ও খাদ্য ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে। এ ধরনের আমদানিনির্ভরতার সঙ্গে আমাদের ডলারের দাম, রিজার্ভসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের বিষয় সামঞ্জস্য রাখা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এখন ডলার–সংকটের কারণে খাদ্য আমদানি কমে যাওয়ার ঘটনা আমরা এ কারণে দেখতে পাচ্ছি। 

দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি, আমাদের প্রায় প্রতিবছর প্রধান খাদ্য চালও আমদানি করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য গমেরও বড় অংশ এখন আমদানিনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের দাম বেড়ে যাওয়ার সমস্যা তৈরি হয়েছে। জ্বালানি খাতেও সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের জ্বালানি খাত দ্রুত আমদানিনির্ভর হয়েছে। তেল, এলএনজি, কয়লাসহ বেশির ভাগ জ্বালানি আমাদের আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। যে কারণে এখানেও ডলারের দাম এবং রিজার্ভ–সংকট বড় সমস্যা। দেশের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকলে কৃষিকাজ, সেচ ও শিল্প কোনোটাই ভালোমতো চলবে না। ফলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি সরাসরি জ্বালানি নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। 

আমরা দেশের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও কৃষি উৎপাদন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার দায়ভার বিদেশের সংকটের ওপর চাপাতে পারি। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব সমস্যা শুরু হয়েছে বলতে পারি। কিন্তু তাতে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। যুদ্ধের আগে থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সমস্যাগুলোর সূত্রপাত হচ্ছিল। তখন আমরা দেশের আর্থিক খাত ও বহির্বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ব্যবস্থা নিইনি। ডলারের দাম টাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে পরিবর্তন করার বিষয়ে আমরা সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। যে কারণে হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। ফলে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্য আমদানির ওপরে একসঙ্গে বড় ধরনের চাপ পড়েছে। এসব পণ্যের আমদানি কমে গেছে। 

দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবছর প্রধান খাদ্য চালও আমদানি করতে হচ্ছে

দেশে এখন চালের দাম নিয়ে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের একটি বড় অংশ কষ্টে আছে। তাদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু ধানের দাম বেশি থাকলে তা কৃষককে বেশি চাষ করার উদ্দীপনা দেয়। চাল আমদানিনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে। গম আমদানি করা সামনের দিনগুলোতে কঠিন হয়ে যাবে। ফলে আমাদের ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। যে কারণে চালের উৎপাদন বাড়াতে হলে দাম কিছুটা বেশি থাকা এক অর্থে ইতিবাচক। 

সরকারের চাল-গমের মজুত এখন যথেষ্ট ভালো। এটা আমাদের জন্য একটি শক্তির দিক। যে সমস্যা এখন তৈরি হয়েছে, খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব মানুষ যে ধরনের সমস্যায় পড়ছে, তা মোকাবিলা করতে হলে তাদের জন্য কম দামে খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এত দিন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নগদ টাকা দেওয়া বা কাজের বিনিময়ে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুশাসনগত সমস্যা ছিল। এখন ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এখন চাইলে আমরা নগদ টাকা গরিব মানুষের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারি। 

কৃষিতে জ্বালানির জন্য আমাদের তেল, ডিজেল ও জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। দেশের সব সেচপাম্প সৌরবিদ্যুতে রূপান্তর করতে হবে। এটা শুরু হয়েছে, কিন্তু তা আরও দ্রুত করতে হবে। কারণ, কৃষিকাজে আমাদের বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের সাশ্রয় আমরা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে করতে পারব। জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ও শিল্পের জন্য সৌরবিদ্যুৎকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

সামগ্রিকভাবে আমাদের আর্থিক খাতে সুশাসনের যে সমস্যা আছে, তা দূর করতে হবে। অন্তত কৃষি ও খাদ্য নিয়ে অব্যবস্থাপনা আর সহ্য করা ঠিক হবে না। কারণ, এখন পর্যন্ত আমাদের এ খাতের যে সমস্যা বৈশ্বিক সংকটের কারণে তৈরি হয়েছে, তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামলানো সম্ভব।

লেখক: বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)–এর সাবেক মহাপরিচালক