ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সত্যের পক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে

পাঠকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাংবাদিক কামাল আহমেদ ও কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগমছবি: তানভীর আহাম্মেদ

‘সত্যে তথ্যে ২৪ বছর’ স্লোগান নিয়ে দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পাঠক উৎসব চলছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। আজ শুক্রবার সকাল আটটায় শুরু হয়েছে আনন্দঘন এ জমজমাট আয়োজন। চলবে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি।

সকালে উদ্বোধনের পরে ছিল প্রথম আলোর লেখকদের সঙ্গে পাঠকদের মুখোমুখি প্রশ্নোত্তরপর্ব। নানা বয়স ও শ্রেণি–পেশার পাঠকেরা প্রিয় লেখকদের সামনে পেয়ে তাঁদের লেখা, লেখকের স্বাধীনতা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইন, পরিবেশ—এমন অনেক প্রশ্ন করেছেন।

পাঠকদের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পারিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাংবাদিক কামাল আহমেদ ও কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম।

এ পর্ব সঞ্চালনা করেন কথাশিল্পী ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক। লেখকেরা জানিয়েছেন ভয়ভীতি, বাধাবিঘ্ন যা–ই আসুক, তাঁরা সত্যের পক্ষে থাকবেন। প্রতিবাদ করবেন মিথ্যা ও অন্যায়ের। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

‘বিচার বিভাগ কি আলাদা হওয়া প্রয়োজন?’ জানতে চেয়ে রাশেদা কে চৌধূরীর কাছে প্রথম প্রশ্নটি করেছিলেন আকলিমা বেগম। উত্তরে তিনি বলেন, বিচারের বাণী যখন নীরবে কাঁদে, তখন স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগের নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়া প্রয়োজন বৈকি।

এ প্রশ্নের সম্পূরক জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমাদের ১৯৭২–এর সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন রাখা হয়নি। পরে সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হলেও সর্বশেষ তা একটি জগাখিচুড়ি অবস্থায় রয়েছে। এখনকার অবস্থা হলো, নীতিনির্ধারকেরা কী চান, তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে।’

এরপরে রংপুরের পাঠক ওমর ফারুক মহিউদ্দিন আহমদের কাছে জানতে চান, তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন, গবেষণাধর্মী বড় বড় বই লেখেন, তাঁর লেখাগুলো খুব জনপ্রিয় হয়। এর কারণ কী, আর লেখার এত সময় পান কেমন করে?

মহিউদ্দিন আহমদ সরস বচনে বলেন, আগে কলাম এক হাতে লিখতেন, এখন কম্পিউটারে দুই হাতে লেখেন। তবে চার হাতে লিখতে পারলে আরও বেশি লিখতে পারতেন। তিনি বলেন, পণ্ডিতদের জন্য নয়, তিনি লেখেন সাধারণ পাঠকের জন্য। এ জন্য খুব সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করেন। তৎসম শব্দ পারতপক্ষে ব্যবহার করেন না। সে কারণে পাঠকেরা সহজে তাঁর কথা বুঝতে পারেন। পাঠকের ভালোবাসাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

প্রশ্ন করছেন একজন পাঠক
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

আফসানা বেগমের কাছে পাঠক সৈয়দ মাহবুব হাসান জানতে চান, ময়মনসিংহের শেরপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে কি না।
উত্তরে আফসানা বেগম জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাসের পরিকল্পনা তাঁর আছে।

তাঁর বাড়ি রংপুরে। সে কারণে ভবিষ্যতে হয়তো রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখতে পারেন। আপাতত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বিভিন্ন সময় লেখা গল্পগুলো নিয়ে একটি বই করছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাসভিত্তিক কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাবুদ জোয়ার্দার আনু মুহাম্মদের কাছে জানতে চান, তাঁরা দেশের তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা নিয়ে যে আন্দোলন করে যাচ্ছেন, সেখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। আদর্শ থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা আছে কি?

তাঁকে আশ্বস্ত করে আনু মুহাম্মদ বললেন, আন্দোলন, নানা তরফ থেকে চাপ আসবে, অসুবিধা হবে। তাঁদের নানা রকম সীমাবদ্ধতা আছে। তবে নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সাহস করে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ফল কী হবে বা ফলের কথা ভেবে আন্দোলন করলে হবে না। কাজ করে যেতে হবে। ফল আপনা থেকে আসবে। আদর্শ থেকে বিচ্যুতির সুযোগ নেই। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্যের পক্ষে কাজ করে যেতে হবে।

নতুন প্রজন্মের পাঠক সামিয়া জাহান ও অলিভিয়ার প্রশ্ন ছিল আনিসুল হকের কাছে, শিশুদের জন্য লেখা কি শৈশবে শুরু করতে হবে? আর বড়রা যখন শিশুদের জন্য লেখেন, তখন তাঁরা কেমন করে বুঝতে পারেন, শিশুদের কী ভালো লাগবে?

আনিসুল হক তাঁদের বলেছেন, যাদের জন্য লেখা হোক না কেন, লেখক হতে গেলে প্রথম শর্ত হলো লিখতে হবে। লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যায়। তবে লেখক হতে গেলে পড়তে হবে প্রচুর। আর ছোটদের জন্য বড়দের লেখা সম্পর্কে তিনি বলেন, বড়রাও তো একসময় ছোট ছিলেন। তখন তাঁর কী ভালো লাগত না লাগত, সেটা তাঁরা জানেন। লেখার সময় সেই ভালো লাগা মন্দো লাগাগুলো তাঁরা সুন্দর করে প্রকাশ করেন।

সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী ইহ্তি শামুন কামাল আহমেদের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা কতটুকু?

কামাল আহমেদ তাঁকে বলেন, সাংবাদিকেরা অনেক কথা বলতে চান, তা হয়তো পুরোপুরি অনেক সময় বলতে পারেন না। মতামত দিতে পারেন না। সরাসরি না বলে, আকার–ইঙ্গিতে, ঘুরিয়ে–পেঁচিয়ে বলতে হয়। মনের মধ্যে অনেক কথা চেপে রাখতে হয়। তবে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমগুলো সব সময় চেষ্টা করে সত্য প্রকাশ করার। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন বিএনপির বড় বড় সমাবেশ হচ্ছে। তাদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু এসব খবর পত্রিকা বা টেলিভিশনে আসছে। ঘটনা যখন ঘটবে, তখন খবর হবে। তবে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকদের সাহসিকতার সঙ্গে আরও সংগ্রাম করে যেতে হবে।

পাঠকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সোহেল চৌধুরী এবং এক তরুণ পাঠক আসিফ নজরুলের কাছে চানতে চান, প্রথম আলোর প্রয়াত যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান যেমন আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতেন, তিনি কি তেমন লিখবেন?

আসিফ নজরুল জানান, এ ক্ষেত্রে মিজানুর রহমান খানের অভাব পূরণ হওয়ার নয়। বিচার বিভাগ নিয়ে লেখার কিছু আইনগত অসুবিধা আছে। ব্রিটিশ আইন অনুসারে আদালত অমান্য কারার দায়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এ অভিযোগ যিনি করেন, তিনি বিচার করেন। ফলে সমঝে চলতে হয়। তবে রাজনৈতিক পর্যালোচনামূলক লেখার পাশাপাশি আইন ও বিচার বিভাগ নিয়ে লেখার বিষয়টি ভবিষ্যতে ভাববেন বলে জানান।

আসিফ নজরুলের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, টেলিভিশনের টক শোগুলোতে যা বলেন বা যেসব লেখা তিনি লেখেন, তাতে কোনো ভয়ভীতির মধ্যে পড়তে হয় কি না। জবাবে তিনি বলেন, আসলে ভয়ভীতি প্রদর্শনের কথা গোপন রাখা ভালো। তবে ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলেই তো লিখতে পারছেন, বলতে পারছেন। এটা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি তাঁর পাঠকদের জানিয়ে দেন। সত্যের পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানও জানান তিনি।