ক্লান্ত পথিকের নিরাপদ আশ্রয় 

১০০ বছর আগের বরেন্দ্রভূমি। আজকের মতো উন্নত রাস্তাঘাট ও যোগাযোগব্যবস্থা তখন ছিল না, ছিল না দ্রুতগামী যানবাহন। ব্যবসা-বাণিজ্য, তীর্থ আর অন্য কাজে মেঠোপথে হেঁটেই চলাচল করত মানুষ। সন্ধ্যার পর সুনসান হয়ে যেত চারপাশ। একদিকে হিংস্র প্রাণীর ভয়, অন্যদিকে চোর–ডাকাতের উপদ্রব। সন্ধ্যা নামার আগেই তাই আশ্রয় খুঁজত মানুষ। কারও মিলত, আর কারও কপালে জুটত ভোগান্তি। মানুষের এমন ভোগান্তি আর কষ্টের কথা চিন্তা করেই ১৯০৮ সালে নওগাঁর পোরশা গ্রামের খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ নিজ বাসভবনের পাশে মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে চার কক্ষের একটি বাড়ি করেন। নাম দেন ‘মুসাফিরখানা’। আশ্রয়ের পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থাও রেখেছিলেন তিনি। সবই মুফতে। মুসাফিরখানা পরিচালনা ও খরচ মেটানোর জন্য দান করে যান ৮০ বিঘা জমি।

সেই জমির ফসল বিক্রির টাকায় আজও চলছে সেই মুসাফিরখানা। মোহাম্মদ শাহ্ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু তাঁর সেই মুসাফিরখানা থেকে উপকৃত হচ্ছেন মানুষ। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ৮০ বছর মাটির ঘরেই চলছিল এর কার্যক্রম। ১৯৮৮ সালে মুসাফিরখানার নামে থাকা জমিজমার আয় থেকে বর্তমান দ্বিতল ভবনটি করা হয়। 

দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্লান্ত মানুষ মুসাফিরখানায় নিরাপদে নিশ্চিন্তে রাত যাপন করতে পারেন। বিনা মূল্যে খাবারের ব্যবস্থাও চালু আছে। এই যুগেও বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়া! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পোরশা সদরের মিনা বাজারে অবস্থিত মুসাফিরখানাটিতে সর্বোচ্চ তিন দিন থাকতে পারেন একজন মুসাফির। পাশাপাশি দুপুর ও রাতে বিনা মূল্যে মিলবে খাবার। অতিথিদের থাকার জন্য রয়েছে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে দুজন মানুষের জন্য দুটি করে খাট। অতিথি বেশি হলে হলরুমেও আছে থাকার ব্যবস্থা। একসঙ্গে সেখানে ৩০ জন থাকতে পারেন। সব মিলিয়ে এই মুসাফিরখানায় ৬০ জন মানুষের থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে। মুসাফিরখানার উত্তর পাশেই একটা পুকুর। তাতে শানবাঁধানো ঘাট। চাইলে সেখানে গোসল করে সারা দিনের শ্রান্তিও দূর করতে পারবেন ক্লান্ত পথিক। ভবনের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকে খাবারের জন্য একটি জায়গা আছে। মুসাফিরখানার পক্ষ থেকে প্রতি বুধবার দুপুরে সেখানে গরিব ও অসহায় মানুষদের বিনা মূল্যে খাওয়ানো হয়। 

মুসাফিরখানায় একদিন

২৩ অক্টোবর গিয়ে দেখা যায়, পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি দ্বিতল ভবন। প্রশস্ত বারান্দা, আবাসিক কক্ষ, হলরুম, খাবারের স্থান, পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম, অজুর স্থানসহ নানা সুবিধা। ভবনটির দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন নকশার শিল্পের সমারোহ। আবাসিক প্রতিটি কক্ষে গালিচা পাতা।

দুই দিন ধরে মুসাফিরখানার একটি কক্ষে আছেন ইব্রাহীম হোসেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে এসেছেন তিনি। বললেন, ‘ভাড়ায় থাকার মতো কোনো আবাসিক হোটেল এই এলাকায় নেই। এমন একটি প্রত্যন্ত স্থানে বিনা খরচে এ রকম থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা, ভাবা যায় না। এখানকার সেবা খুব ভালো। লোকজন খুব আন্তরিক।’

১৭ বছর ধরে মুসাফিরখানাটির সেবক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, যাঁরা থাকেন নিজেদের বিছানা তাঁদের নিজেদেরই প্রস্তুত করে নিতে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোও তাঁদেরই দেখভাল করতে হয়। প্রতিদিনই ছয়-সাতজন বিনা খরচে এখানে রাত যাপন করেন। দুপুরে খেতে চাইলে সকাল নয়টা আর রাতে খেতে চাইলে বিকেল চারটার মধ্যে জানাতে হয়।

মুসাফিরখানার প্রতিষ্ঠাতার বংশধর ষাটোর্ধ্ব ময়নুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ আমার দাদার বাবা। ওনার পর আরও অনেকে মুসাফিরখানার নামে জমি দান করেছেন। বর্তমানে মুসাফিরখানার নামে প্রায় ২০০ বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। এসব জমির আয়ের টাকা দিয়ে মুসাফিরখানাটি চলে।’ 

একটি কমিটির মাধ্যমে মুসাফিরখানাটি পরিচালিত হয়। বর্তমানে মুসাফিরখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি জামিলুর রহমান শাহ ও সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম শাহ। অতিথিদের সার্বিক দেখভালের জন্য একজন ম্যানেজার ও দুজন কর্মচারী আছেন।

প্রায় ২৫ বছর ধরে মুসাফিরখানার ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বললেন, এখন প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন অতিথি থাকেন। অন্যান্য সময়ের তুলনায় পবিত্র রমজান মাসে অতিথিদের আগমন বাড়ে। তখন প্রতিদিন ২০-২২ জন রাত যাপন করেন। মুসাফিরখানার জমির টাকা দিয়ে এসব খাওয়া খরচ চলে। স্থানীয় লোকজনও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

লেখক:প্রথম আলোর নওগাঁ প্রতিনিধি