নিজের তৈরি আচারসহ আরএস ফুড কর্নারের নানা পণ্যসহ মাসুমা আক্তার
ছবি: আনোয়ার পারভেজ

প্রযুক্তি যেন আমার জীবনে বড় আশীর্বাদ। মুঠোফোনে ‘রং নম্বর’ থেকেই রাজিবুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয়, বিয়ে। মুঠোফোনই জুগিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ। করোনায় রাজিবুল বেকার হয়ে পড়লে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি। শুরুটা মসৃণ ছিল না। সংকট আর হতাশা ছিল। তবু থেমে যাইনি। সব বাধা ডিঙিয়ে সাফল্য ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পা রেখেছি। হতাশার অন্ধকার থেকে টেনে তুলে আমাকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছে প্রথম আলো।  

যেভাবে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় আমার বাড়ি। বাবা কাঁচামাল ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। ২০১০ সালে এসএসসি পাসের পর এইচএসসিতে ভর্তি হলেও পড়াশোনা এগোয়নি। বগুড়া শহরের কইগাড়ি এলাকার রাজিবুলের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বিয়ে। শুরুতে তাঁর পরিবার আমাকে মেনে নিতে চায়নি।

সব বাধা ডিঙিয়ে সাফল্য ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। হতাশার অন্ধকার থেকে টেনে তুলে আমাকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছে প্রথম আলো।

রাজিবুল তখন শহরের একটি চার তারকা হোটেলে চাকরি করতেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে। দুই সন্তান আর পুরো পরিবার রাজিবুলের বেতনে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ করোনার প্রকোপ। বিধিনিষেধ শুরু হলে হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন তিনি। সংসার প্রায় অচল। কোলে তখন ছয় মাসের শিশুকন্যা। সন্তানের দুধ কেনার টাকা নেই। বড় মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারি না। দেবরের পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম। রাজিবুল চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিতে থাকেন। কিন্তু করোনার মধ্যে কে কাজ দেবে?

২০২০ সালের ২৯ মে। দুর্বিষহ একঘেয়েমি ঘরবন্দী জীবন। সময় কাটাতে ফেসবুকে ঢুঁ মারি। হঠাৎ নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) ফেসবুক পেজে চোখ আটকে যায় (এখন এটি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট হিসেবে পরিচিত)। পেজ দেখে কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাই। পেটার ক্ষুধা মেটাতে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু মূলধন পাব কোথায়? স্বজন-পরিচিতদের কাছে টাকা ধার চেয়ে ব্যর্থ হই। অনটনের কথা শুনে কেউ কেউ চাল-ডাল কিনে দিতে চাইলেন। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম! 

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া বড় মেয়েটি বাবার কাছ থেকে দু-এক টাকা নিয়ে মাটির ব্যাংকে জমাত। কান্না দেখে মাটির ব্যাংক ভেঙে সে আমাকে ৩৬৫ টাকা বের করে দিল। ৬৫ টাকা মেয়ের হাতে ফেরত দিলাম। ৩০০ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। বাজার থেকে বড় আলু এনে চার কেজি চিপস তৈরি করি। কিন্তু ক্রেতা পাব কই? ফেসবুকে পেজ খুলে পণ্যের ছবি আপলোড করি। অনলাইনে চিপস বিক্রি করে হাজারখানেক টাকা লাভ হয়। এতে উৎসাহ বাড়ে।

অভাবের কথা শুনে মা আর ছোট বোন ২০ হাজার টাকা পাঠান। সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে ১০ হাজার টাকা শেষ। বাকি ১০ হাজার টাকায় সিরাজগঞ্জের তাঁত থেকে কিছু শাড়ি এনে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। কিন্তু সাড়া কম। বাধ্য হয়ে চিন্তা বদলাই। 

আকাল কাটে গরুর মাংসের আচারে

শৈশবে কোরবানির মাংস ঝাল মেখে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে বয়ামে সংরক্ষণ করা দেখেছিলাম। নিজেই ছোটবেলা থেকেই আচারের প্রতি দুর্বল ছিলাম। মায়ের কাছে নানা ধরনের আচার তৈরিও শিখেছিলাম। সে ধারণা থেকেই গরুর মাংসের আচার তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। ইউটিউব থেকে আচার তৈরির আরও প্রণালি রপ্ত করলাম। এরপর গরুর মাংসের আচার তৈরি করে অনলাইনে দিই। ‘উই’ প্ল্যাটফর্মেও ছবি দিই। ব্যাপক সাড়া। এরপর ঘি তৈরি শুরু করি।

তিন মাসের ব্যবধানে আসে সাফল্য। আমার উদ্যোগ নিয়ে গত বছরের ৩ জুলাই প্রতিবেদন করে প্রথম আলো। এরপর আমাকে ফোন করেন স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) থেকে পেলাম জামানতবিহীন ৫ লাখ টাকা ঋণ। ব্যবসার পুঁজি বাড়ে। পাল্টে যায় গল্প। জাপানসহ ১৭টি দেশে যাচ্ছে ঘি আর গরুর মাংসের আচারসহ অন্যান্য আচার। দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে পণ্যের সুনাম। এ ছাড়া দই, লাচ্ছা সেমাই, শর্ষের তেলসহ নানা পণ্য বিক্রি করেছি। নিজের ব্র্যান্ডের নাম দিয়েছি আরএস ফুড কর্নার। কাঁচামাল কেনা, কুরিয়ারে পণ্য বুকিংসহ সব কাজে সহযোগিতা করছেন রাজিবুল।

শুরু থেকেই পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। শতভাগ খাঁটি দুধ থেকে ঘি উৎপাদন এবং আচারের গুণগত মান ঠিক রেখে নতুন নতুন স্বাদ আনার চেষ্টা করছি। 

মিলল স্বীকৃতি

এ বছর উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অর্গানাইজেশন (উইও) থেকে নারী উদ্যোক্তার সম্মাননা পেয়েছি। বিদেশে পণ্য রপ্তানির ওপর উই আয়োজিত ‘এক্সপোর্ট ইনকিউবেটর পাওয়ার গ্র্যাজুয়েট’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়েছি। ব্যবসাটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে কাজ করছি। কারণ, স্বপ্ন ছোঁয়ার এখনো অনেক পথ বাকি। যেতে হবে আরও বহুদূর। 

(অনুলিখন: আনোয়ার পারভেজ, নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া)