বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে বিকাশ

ঢেউটিন
ছবি: সংগৃহীত

দেশে ঘরবাড়ি বানানোর জনপ্রিয় উপকরণ ঢেউটিনের উৎপাদন শুরু হয় চট্টগ্রামেই। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার একটি সরকারি কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদিত হতো। তবে কারখানাটিতে উৎপাদিত ঢেউটিন দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো যেত না। তাই অনেকে আমদানি করতে শুরু করেন ঢেউটিন। ঢেউটিনের চাহিদা বাড়তে থাকায় নব্বইয়ের দশকে উদ্যোক্তারা কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। দেশে বেসরকারি খাতে ঢেউটিনের এই অগ্রযাত্রার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম।

শহর থেকে গ্রামগঞ্জ—সবখানেই ইটের স্থাপনা বেড়েছে। শণ ও টিনের চালায় নির্মিত ঘরও কমছে পাল্লা দিয়ে। তবে বৈচিত্র্য এবং বহুমুখী ব্যবহার উপযোগিতার কারণে ঢেউটিনের চাহিদা কমেনি।

শুরু যে প্রতিষ্ঠানে

বাংলাদেশের প্রথম সরকারি ইস্পাত কারখানা ‘চিটাগাং স্টিল মিলস’। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় স্থাপিত এই কারখানার মাধ্যমেই দেশে ঢেউটিন খাতের যাত্রা শুরু। অবশ্য কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে দেশ স্বাধীনের আগে, ১৯৬৭ সালে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে পৃথক কোম্পানিতে পরিণত করা হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কারখানাটিতে বছরে সাত থেকে আট হাজার টন ঢেউটিন উৎপাদিত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে ১৯৭৬ সালে করা বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায়। যদিও ১৯৯৯ সালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রকাশনায় উল্লেখ করা তথ্যে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর পর্যন্ত চিটাগাং স্টিল মিলসের উৎপাদন ছিল সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ। ১৯৭৯-৮০ এবং ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে সক্ষমতার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত কারখানাটি ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বন্ধ ঘোষণা করা হয় কারখানাটি, যদিও উৎপাদন বন্ধ হয়েছে এর কয়েক বছর আগে। বন্ধের আগে কারখানাটিতে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন।

কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলেও এই কারখানার অভিজ্ঞতা ঢেউটিন উৎপাদনে সমৃদ্ধ করেছে বেসরকারি খাতকে।

চাহিদা মেটাতে আমদানি

চিটাগাং স্টিল মিলসে উৎপাদিত ঢেউটিনে দেশের চাহিদা মেটানো যেত না। তাই চাহিদা মেটাতে ঢেউটিন আমদানি করতে শুরু করেন অনেক ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২৯ হাজার ১৫৬ টন ঢেউটিন আমদানি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, শুরুর দিকে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পোদ্যোক্তা আখতারুজ্জামান চৌধুরীসহ হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ঢেউটিনের আমদানিকারক ছিলেন।

আশির দশকে চট্টগ্রামের ইলিয়াস ব্রাদার্স (হাতি মার্কা), আসিফ স্টিল (সোয়ান ব্র্যান্ড) ও এনজিএস গ্রুপ (লাড্ডু মার্কা), সিআর (কোল্ড রোলড) শিট আমদানি করে জিংকের প্রলেপ করে বাজারে ছাড়ে। পরে দেশে সিআর কয়েল তৈরির কারখানা স্থাপন শুরু হলে আমদানি কমতে শুরু করে।

দেশেই সিআর কয়েল তৈরির কারখানা

আকরিক লোহাকে গলিয়ে তৈরি হয় এইচআর বা হট রোলড কয়েল। সেখান থেকে পরিশোধিত ইস্পাতের পাত বা কোল্ড রোলড (সিআর) কয়েল তৈরি করা হয়। এরপর সেটিতে প্রলেপ লাগিয়ে তৈরি হয় ঢেউটিন। রঙিন ঢেউটিন তৈরি করতে আরও এক দফা প্রলেপ লাগানোর প্রয়োজন পড়ে।

আশির দশকেও ব্যবসায়ীরা সরাসরি সিআর কয়েল আমদানি করে প্রলেপ লাগিয়ে ঢেউটিন বাজারে ছাড়তেন। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে সিআর কয়েল তৈরির কারখানা স্থাপন শুরু হয়। বাজারে ঢেউটিনের চাহিদা বাড়ায় উদ্যোক্তারা এসব কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শিল্প গ্রুপ সিআর কয়েল তৈরির কারখানা স্থাপন করে। এসব শিল্প গ্রুপের মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের, পিএইচপি, টি কে, কেডিএস এবং এস আলম। পরে একাধিক কারখানা যুক্ত হয় এ খাতে।

এইচআর কয়েল থেকে কারখানায় ঢেউটিন তৈরি করে বাজারজাতের ক্ষেত্রে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে আবুল খায়ের ও পিএইচপি গ্রুপ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের হাতেই বাজারের প্রায় ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ। ব্যবসায়ীরা জানান, বড় শিল্প গ্রুপের বাইরে ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো সিআর শিট আমদানি করে ঢেউটিন বানিয়ে বাজারে সরবরাহ করছেন। অনেকে দেশে স্থাপিত কারখানাগুলো থেকে সিআর শিট কিনে ঢেউটিন বানান।

বেড়েছে বৈচিত্র্য

দেশের কারখানাগুলোতে শুরুতে কেবল জিংকের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন উৎপাদিত হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢেউটিনের উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে জিংক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রলেপযুক্ত ঢেউটিন, রঙিন ঢেউটিন, কারখানার ছাদ তৈরির প্রোফাইলসহ (বড় ঢেউয়ের টিন) অনেক পণ্য।

ঢেউটিন কারখানার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিবর্তিত চাহিদার কথা মাথায় রেখে পণ্য তৈরি হচ্ছে কারখানায়। বৈচিত্র্য বাড়ায় পণ্যের বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে।

বসতঘরের চালা ও ঘেরাও তৈরিতে ঢেউটিনের চাহিদা কিছুটা কমলেও এখন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও নির্মাণকাজে ঢেউটিনের ঘেরাও দেওয়া হচ্ছে। অনেকে ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে রঙিন ঢেউটিন ব্যবহার করেন। কারখানার প্রোফাইলের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।