২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ছবির চেয়েও উজ্জ্বল

প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা প্রকাশ করছি দেশে–বিদেশে থাকা আমাদের পাঠকের লেখা। তাঁরা লিখেছেন তাঁদের নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্য অভিজ্ঞতার গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

১৯৭৩ সাল। আমি উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। থাকি রংপুরে। আমরা কয়েকজন প্রিন্সিপাল আপার কাছে বায়না ধরলাম একটা শিক্ষাসফরের জন্য। অনুমতিটা মিলেও গেল। দিন–তারিখ ঠিক হলো। সাব্যস্ত হলো, চারজন স্যার আর আপা আমাদের সঙ্গে যাবেন।

২০ জন ছাত্রী আর ৪ জন শিক্ষকসহ আমাদের দলটা রওনা দিল। ট্রেনে প্রথম শ্রেণির একটা কম্পার্টমেন্টে সিট রিজার্ভ করা হয়েছে। বন্ধুরা মিলে ঢাকায় যাচ্ছি। কী দেখতে পাব না পাব, জানি না। জীবনে কখনো ঢাকায় যাইনি। ঢাকায় যাচ্ছি সেটাই বিরাট উত্তেজনা। শিক্ষকেরা বললেন, মেয়েরা গান ধরো। আমাদের বন্ধু রোকসানা আফরোজ সেই বয়সেই রংপুর বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। আমরা ডাকতাম রিক্তা। সে একের পর এক গান গেয়ে চলল। রিক্তা এখন আর বেঁচে নেই।

ভোরবেলায় আমরা কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। দুটো জিপ গাড়ি এসেছে আমাদের নিতে। উঠলাম এসে সিদ্ধেশ্বরী কলেজের হোস্টেলে। সেদিন আমাদের বিশ্রাম নেওয়ার দিন। পরদিন সকাল নয়টায় আমাদের তৈরি থাকতে বলা হলো। কথামতো পরদিন নির্ধারিত সময়ে আমরা তৈরি। আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা বলা হলো না। নানা রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি একটা ভবনের সামনে এসে থামল। মনে হলো, সরকারি কোনো অফিস। কিছুক্ষণ আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। একসময় ভেতরে যেতে বলা হলো। আমরা সার বেঁধে যাচ্ছি। ঠিক বুঝতে পারছি না, কোথায় এসেছি। 

আমাদের বড় একটি কক্ষে ঢোকানো হলো। ঢুকে সামনে যাঁকে দেখতে পেলাম, তাতে উত্তেজনায় আমার হাত–পা–ঘাড়ে কেমন গরম হাওয়া বইতে লাগল। আমাদের চোখের সামনে বসে আছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কী দীর্ঘকায় দেখতে!

শিক্ষকেরা আমাদের কলেজের নাম বলে নিজেদের পরিচয় দিলেন। এরপর আমাদের ছাত্রীদের পালা। শুরুটাই হলো আমাকে দিয়ে। মানুষ নিজের নাম দিয়ে শুরু করে। উত্তেজনায় কিনা জানি না, আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। প্রথমেই নিজের নামটা না বলে আমি বলতে শুরু করলাম, ‘স্যার, আমি ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি বেগম রোকেয়া কলেজের কলেজ পত্রিকার সম্পাদিকা। এই পত্রিকাটা আপনার জন্য।’ বলে ব্যাগ থেকে একটা পত্রিকা বের করে তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।

বঙ্গবন্ধু পত্রিকাটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর নাম কী রে?’ কী যে গমগমে তাঁর কণ্ঠ।

বললাম, ‘স্যার, আমার নাম রেহানা।’ খানিকটা চমকিত হয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এ কী রে, তুই তো আমার ছোট মেয়ের নামটা কাইড়া নিছস।’

পরিস্থিতির আতিশয্যে এগিয়ে গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধু্র পদধূলি নিলাম।

বঙ্গবন্ধু আমাদের সবাইকে স্যান্ডউইচ দিতে বললেন। এরপর একজন স্যারের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মেয়েদের খাবারের জন্য এটা রেখে দিন, প্লিজ।’ তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কিছুদিন আগে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অথচ কী নিরহংকার, সাদামাটা আর দরাজ উপস্থিতি মানুষটার। আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম।

প্রধানমন্ত্রীর দর্শন শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করাতে। আরেক দিন গেলাম সংসদের কার্যক্রম দেখতে, এরপর এফডিসিতে। রাজ্জাক, কবরী, শাবানাসহ অনেক অভিনেতা–অভিনেত্রীকে দেখতে পেলাম চোখের সামনে। কথা বললাম তাঁদের সঙ্গে। সেই বয়সে এসব তো বিরাট ব্যাপার!

একদিন আমরা গেলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে। কবির সামনে বসে রিক্তা গাইল ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।’ চেয়ে দেখি, কবির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে।

স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে, সেই সফরে সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন মকবুল হোসেন নামে কোনো এক মন্ত্রীর সচিব। ফিরে আসার দিন সাহস করে তাঁকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের ছবিটা পাঠিয়ে দিতে। আমরা মফস্‌সলের এক কলেজের ছাত্রী। ভাবতে এখন অবিশ্বাস্য লাগে যে সত্যিই তিনি ছবিটি পাঠিয়েছিলেন। যক্ষের ধনের মতো ছবিটি আগলে রেখেছিলাম। পরে একদিন কেউ দেখতে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। তবু ছবির চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিটা।