মুক্তিযুদ্ধই আমাদের ভিত্তি

রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে গত ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে দেবাশীষ মিত্র, মঈদুল হাসান, আমীর-উল ইসলাম ও সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইটি বের করেছে প্রথমা প্রকাশন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর, কারওয়ান বাজার সিএ ভবনের মিলনায়তন। নতুন দৈনিক প্রথম আলোর আসন্ন আত্মপ্রকাশকে অভিনন্দন জানাতে উপস্থিত হয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রথম আলোর আগমনী বার্তার সঙ্গে ঘোষণা দেওয়া হলো প্রথম আলোর অঙ্গীকারগুলো, যার অন্যতম ছিল—‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে থাকবে প্রথম আলো’। প্রথম আলো আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। সেদিনের সম্পাদকীয়তেও প্রতিধ্বনিত হয় একই অঙ্গীকার।

আত্মপ্রকাশের পর থেকে মার্চ ও ডিসেম্বরজুড়ে প্রথম আলোর প্রথম বা শেষের পাতায় মুক্তিযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিরিজ লেখা প্রকাশ করা হয়।

এরপর পেরিয়ে গেছে ২৪ বছর, প্রথম আলো তার অঙ্গীকার সমুন্নত রেখেছে। গত ২৪ বছরে মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক প্রতিটি দিবসে প্রকাশ করেছে ৮ থেকে ২০ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র। ক্রোড়পত্রগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতা, দেশের নেতৃস্থানীয় গবেষক, লেখক, প্রত্যক্ষদর্শী এবং ক্ষতিগ্রস্তদের লেখা প্রকাশিত হয়। ক্রোড়পত্রগুলো সাজানো হয় নির্দিষ্ট বিষয় বা থিমের ভিত্তিতে, আবার কখনো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে। ক্রোড়পত্রে যুদ্ধের পরিকল্পনাকারী, নেতৃত্বদানকারী আর মাঠপর্যায়ের যোদ্ধারা তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অপ্রকাশিত নথিও ক্রোড়পত্রে ছাপা হয়। এ ছাড়া আঞ্চলিক সংস্করণগুলোতে ওই এলাকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।

ক্রোড়পত্র ছাড়াও সারা বছরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলো বিভিন্ন ধরনের সংবাদ, লেখা ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ও অপ্রকাশিত ঘটনা প্রথম আলোই প্রথম জনসমক্ষে এনেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

আত্মপ্রকাশের পর থেকে মার্চ ও ডিসেম্বরজুড়ে প্রথম আলোর প্রথম বা শেষের পাতায় মুক্তিযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিরিজ লেখা প্রকাশ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে অসমসাহসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে এই খেতাবধারীদের বড় অংশ লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যায়। প্রথম আলো এসব জাতীয় বীরকে সামনে এনেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বীরদের মধ্যে ৬৩৬ জনের সঙ্গে সরাসরি অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচয় সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য ২০১১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। পরে প্রথম আলো এই বীরদের আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেয়। একইভাবে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০২১ সালে ৩৩৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় জাতির সামনে তুলে ধরে প্রথম আলো।

ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ সাময়িকীর প্রতিটি সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বৃহৎ কলেবরে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রথম আলো ২০০৫ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি গোলটেবিলের আয়োজন করে। সেখানে দেশের মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসবিদ, আইনজ্ঞ, সুশীল সমাজের মানুষসহ অনেকেই অংশ নেন।

‘প্রথমা প্রকাশন’ প্রথম আলোর সহযোগী সংস্থা। ২০০৯ সালে ‘একাত্তরের চিঠি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রথমা আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমা বর্তমানে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রকাশনা সংস্থা। প্রথমা এ পর্যন্ত ৭৪৩টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৫০টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলির সংকলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বই প্রথমার প্রকাশনার তালিকায় রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজীবনী ও জীবনীগ্রন্থও এই তালিকায় বিশেষ স্থান জুড়ে আছে। প্রথমা মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি বইয়ের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে। প্রথমা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো সর্বোচ্চ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

২০২১ সাল ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। প্রথম আলো বছরব্যাপী নানা আয়োজনে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করে। এ বছরের ১ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ওই দিনে সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এপ্রিলে ১৯০ পৃষ্ঠার একটি বিশেষ সাময়িকী, বিভিন্ন দিবসে ৯টি ক্রোড়পত্র ও ১০–১২টি বিশেষ প্রতিবেদন/লেখা প্রকাশ করা হয়।

সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সর্বজনীন ও সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে একটি ওয়েবসাইট (চিরন্তন ১৯৭১) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ওয়েবসাইটটি নির্মাণাধীন। এতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিসহ ১৯৭১ সালে সংঘটিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নথি, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিওসহ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার, প্রথম আলোয় প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রতিবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি, বিভিন্ন বাহিনী ও সেক্টরের যুদ্ধ, প্রবাসী সরকারের তথ্যাবলিসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রচুর তথ্য সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। ধারণা করা যায়, এটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর সবচেয়ে বড় ভার্চ্যুয়াল আর্কাইভসে পরিণত হবে।

প্রথম আলো সব সময় মুক্তিযুদ্ধের অনালোকিত ও অপ্রকাশিত ইতিহাস সন্ধান করে চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত দি শিলিগুড়ি কনফারেন্স এই উদ্যোগের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

প্রথম আলো ২৪ বছরের অভিযাত্রায় সব সময় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে চলেছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভবিষ্যতেও প্রথম আলো এই লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে যাবে।

লেখক: গবেষক।