বার্লিনের পথে কুড়িয়ে পাওয়া বই

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

বিদেশে যাওয়ার সুযোগ কম হয়। একটু-আধটু সুযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মহামারিতে। অনেক বছর পর গত বছর দিল্লি গিয়েছিলাম নিজের জটিল চিকিৎসা করাতে। এবার সুযোগটা এল।

বিদেশে যে শহরে যাই, সেই শহরের বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা আমার অভ্যাস। বই কিনি বা না কিনি বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারবই।

কদিন আগে বার্লিনে স্বাস্থ্য সম্মেলন কাভার করতে গেছি। জেনে গেছি শহরটিতে ইংরেজি কম, খরচ বেশি। বার্লিন ওয়াল, চেক পয়েন্ট, হলোকাস্ট মেমোরিয়ালসসহ কী কী দেখব, সে তালিকা মাথায় ছিল। মুঠোফোনে মাকে বার্লিন যাওয়ার কথা জানাতেই, মা বলেছিলেন জার্মানি থেকে আইনস্টাইনের ওপর লেখা বই আনতে। মানসিক চাপে পড়েছিলাম।

১৪ অক্টোবর সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের দুপুরের খাবারের আগে মুঠোফোনে বার্তা এল। মোহাম্মদ মফিজুর রহমান। পোটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী। একসময় আইসিডিডিআরবির গবেষক ছিলেন। বছর দশেক আগে খুলনার দক্ষিণের জনপদ কালাবগি এলাকার পানির লবণাক্ততা মেপে দিয়েছিলেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় নাম দেখে সম্পর্ক ঝালাই করতে এসেছেন।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় একই সঙ্গে দুজনের চোখ আটকে গেল। কংক্রিটের রাস্তায় বইয়ের একটি মলাট পড়ে আছে। রাস্তায় কাগজের টুকরাও দেখা যায় না, থাকে শুধু ঝরা পাতা। মলাটের ভাষা ইংরেজি।

চেহারা পাল্টেছে, মফিজুর পাল্টাননি। বললাম, আমার হোটেল ১০ মিনিট হাঁটার পথ। সেখানে আইসিডিডিআরবির আরও দুজন বিজ্ঞানী-গবেষক আছেন—শামস-এল-আরেফিন ও এহসানূর রহমান। মফিজুর হোটেলে যেতে চাইলেন পুরোনো কলিগদের সঙ্গে দেখা করতে।

আমি বেশি দেশ বা শহর দেখিনি। অভিজ্ঞতা কম। তবে বার্লিন ভালো লেগেছে। ভালো লাগা থাকবে বহু বছর। পরিপাটি শহর। হাঁটাপথ, বাইসাইকেলের লেন, গাড়ির রাস্তা সমান্তরাল চলেছে। শৃঙ্খলা সবখানে। পায়ে হাঁটার এক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার বাইসাইকেল চালকের ঝাড়ি শুনতে হয়েছে। জার্মান ভাষায় হয়তো বলেছে, ‘তুমি আমার লেনে কেন’ বা ‘তুমি ভুল পথে হাঁটছ তো’। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো কী সুন্দর। একটা শহরে দেখার মতো এত এত অট্টালিকা। অবাক করা কাণ্ড।

যাহোক, হোটেলে পুরোনো কলিগদের সঙ্গে দেখা করে, সেলফি তুলে মফিজুর বের হলেন। সঙ্গে আমিও। সতর্ক হয়ে হাঁটছি। সরকার পতনের ভেতরের কাহিনি শুনতে আগ্রহী মফিজুর। আমি আগ্রহী জার্মানিতে বাংলাদেশিদের পড়ালেখার খবর জানতে। মফিজুর যাবেন বাস স্টপেজে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় একই সঙ্গে দুজনের চোখ আটকে গেল। কংক্রিটের রাস্তায় বইয়ের একটি মলাট পড়ে আছে। রাস্তায় কাগজের টুকরাও দেখা যায় না, থাকে শুধু ঝরা পাতা। মলাটের ভাষা ইংরেজি। দুজনেই থমকে যাই, কিন্তু থামি না। কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকি। ১০-১২ সেকেন্ড চলার পর মফিজুর দাঁড়িয়ে যান। রাস্তার পাশে যত্নে ছাঁটা ঝোপের ওপর একটি বই। মলাটবিহীন। মফিজুর বললেন, ‘শিশিরদা, ফেলে আসা মলাটটা সম্ভবত এই বইয়ের।’ আমরা পেছনে ফিরি। মলাটের সঙ্গে বই মিলে যায়।

কুড়িয়ে পাওয়া সেই বই

গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকের বিখ্যাত আইরিশ শিল্পী-সংগীতকার ভ্যান মরিসনকে নিয়ে লেখা বই, ‘হোয়েন দ্যাট রাফ গড গোজ রাইডিং’। তাঁর বিখ্যাত গান ‘ব্রাউন আইড গার্ল’। বইটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক, সংগীত সাংবাদিক গ্রেইল মার্কাস। দুজন সম্পর্কে আমার ধারণা কম। তবু মফিজুর যখন বইটি আমার হাতে দিলেন আমার আনন্দের সীমা ছিল না। রাস্তায় মানুষ কত কিছু পায়। সোনাদানা, টাকা-ডলার, ব্যাগ-মানিব্যাগ, এমনকি শিশুও। তাই বলে বই! বার্লিনের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া বই!

হোটেলে ফিরে বইয়ের ওপর বারবার হাত বোলাই, বইটির বয়স হয়েছে। পাতাগুলো ধূসর। কিন্তু একটি পাতাও ছেঁড়া না, কোথাও কিছু লেখা নেই। কে বইটি কিনেছিলেন, এখন কেন রাস্তায়? উত্তর কেউ জানে না। বার্লিন থেকে একটা বই তো হলো।
১৫ অক্টোবর সম্মেলন শেষে অন্যরা দেশে ফিরলেন। আমি থেকে গেলাম। পরের দিনের আধা বেলা মফিজুর আমাকে নিয়ে ঘুরলেন। মূলত পায়ে হেঁটে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় বার্লিন শহরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। বিশাল পাঁচতলা ভবনের পুরোটাই বইয়ের। জাতি কেন বড় হয়, বোঝা যায়। জার্মান ছাড়া অন্য ভাষার বই কম। তাই ইংরেজি বইও কম। ইংরেজি শাখাটি ঢাকা শহরের বড় বইয়ের দোকানের চেয়েও বড়।

আইনস্টাইনের ওপর একটি বই খুঁজে পেলেন মফিজুর। মনে ধরল না। সময় পার হয়। মফিজুর বিদায় নেন। আমি আরও ঘণ্টা দুই কাটাই। বই বেছে বেছে স্তূপ করি। একসঙ্গে এত ভালো বই। পকেটের কথা ভাবি। কোনো বই না কিনে হোটেলে ফিরি।
অন্তত একটা বই তো হয়েছে। রাতে ঘুমানোর আগে পাতা উল্টাই। পৃথিবীর একটা গুরুত্বপূর্ণ শহরে কুড়িয়ে পাওয়া বই। যে যা–ই ভাবুক, আমার কাছে অনেক বড় ঘটনা।

আইরিশ শিল্পী-সংগীতকার ভ্যান মরিসন
ছবি–এএফপি

বার্লিন ওয়াল, হলোকাস্ট মেমোরিয়ালসের মতো বই পাওয়ার ঘটনাও জীবনে ভুলব না।
পরদিন, বার্লিনের শেষ দিন, একা ঘুরেছি। সকাল ১০টায় বেরিয়ে হোটেলে ফিরি সন্ধ্যা সাতটায়। সারাটা দিন হেঁটেছি। অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে মাথায় ছিল বই। আজ দোকানে ঢুকেই মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আইনস্টাইনের ওপর বই কী কী আছে। সুন্দরী চারটি বই দেখালেন। মনের মতো একটি পেলাম। আরও ছয়টি কিনলাম।
হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে। ভেবেছি কী সুন্দর শহর। আর কি কোনো দিন এই শহরে আসার সুযোগ হবে? ভেবেছি, যে বইগুলো কিনতে পারিনি, সেগুলোর কী হবে। রাতে ব্যাগ গোছানোর সময় মনে এল, সবচেয়ে মূল্যবান বইটির জন্য এক ইউরোও খরচ হয়নি।

ঢাকায় ফেরার পরের দিন বিকেলে ভারী ব্যাগ নিয়ে অফিসে ঢোকার পথে মতি ভাইয়ের সঙ্গে লিফটের সামনে দেখা। মনে মনে যা চাইছিলাম, তাই ঘটল। আমাকে এক মিনিটের জন্য দোতলায় ডাকলেন।

বার্লিনের স্বাস্থ্য সম্মেলন কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা বললাম। বললাম, বার্লিন ওয়ালের গ্রাফিতি অসাধারণ। মতি ভাই ওয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাতে বললেন। ঘাড় নাড়লাম। টুকটাক কথা হলো। সম্মেলন নিয়ে যা লিখিনি, তা লিখতে বললেন। ঘাড় নাড়লাম। বিদায় নেওয়ার আগে ব্যাগ খুলে বললাম, একটা বই এনেছি। কুড়ানো বইটি তাঁর হাতে দিলাম। কষ্ট পেলেও খুশি হলাম।  

শিশির মোড়ল, বিশেষ প্রতিনিধি