সংবাদ প্রকাশের পর সবই স্বপ্নের মতো বদলে গেল 

নরসিংদীর মির্জাপুরে এক কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। আট বছর আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের গ্রামে বেড়াতে আসা এক তরুণের সঙ্গে আমার সখ্য হয়। কিছু মানুষ বিষয়টি নিয়ে গ্রামে ভুল তথ্য ছড়ায়। আমরা দুজনই মানুষকে সত্য জানানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। এ কারণে ১৮ বছর বয়সী সেই তরুণের সঙ্গে মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়।

বিষয়টি দুই পরিবারের কেউ ভালোভাবে নিতে পারেননি। আমার স্বামী স্বপন মিয়া পড়াশোনা না জানা মানুষ। বিয়ের পর সে রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাত।

বাল্যবিবাহের পর কোনো কিছু বোঝে ওঠার আগেই আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তারপর একে একে আরও দুই সন্তান আসে। গ্রামে রিকশা চালিয়ে তিন সন্তানকে লালন–পালনে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আমি চতুর্থবারের মতো গর্ভধারণ করি।

ভাগ্যবদলের আশায় আমরা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চলে আসি। এখানে চার হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিই। আমি সন্তানদের দেখাশোনা করি। আর স্বপন বাসার পাশেই একটি ছাপাখানায় আট হাজার টাকা বেতনে কাজ নেয়। সামান্য বেতন, সেটাও ঠিকঠাক মিলত না। সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না–খেয়ে দিন কাটে। স্বপন চাকরি ছেড়ে দেয়। অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোনো কারখানার মালিকের বাধায় কোথাও চাকরি হয় না।

স্বপন দিনমজুরির কাজও ঠিকঠাক পাচ্ছিল না। অপরিচিত শহরে কেউ তাকে রিকশাও দেয় না। বকেয়া পরিশোধ না করায় বাসার পাশের মুদিদোকানিও পণ্য দেন না। এভাবে তিন মাস চলে যায়। ভাড়া বকেয়া পড়ায় বাড়িওয়ালা বাসা ছাড়ার তাগিদ দেন।

এমন অনেক দিন গেছে, সন্তানদের মুখে খাবার দিতে পারিনি। ক্ষুধায় ওরা কান্নাকাটি করত। খাবার দিতে না পেরে যন্ত্রণায় ওদের মারধর করতাম। ওরা কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এরই মধ্যে এক ঝড়ের রাতে আমার প্রসবব্যথা ওঠে।  হাসপাতালে যাওয়ার মতো টাকা নেই। একজন ধাত্রীর খোঁজে স্বপন বাড়ি বাড়ি ছুটে যায়। রাতের বেলা কেউ এগিয়ে আসে না। শেষে স্বামীর সহায়তায় কন্যাসন্তানের জন্ম দিই।

অভাবের সংসারে আরেকটি শিশুসন্তান লালন–পালনের সামর্থ্য নেই। অপরিচিত এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে সদ্যোজাত শিশুকে দত্তক দিই। তখন আবার আমাদের নামে গুজব ছড়ায়। লোকজন বলাবলি করে, ৩০ হাজার টাকায় আমরা সন্তান বিক্রি করে দিয়েছি। নানাজন নানা কথা শোনায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে আমি তখন আত্মহত্যার কথা ভাবছিলাম।

এর মধ্যে প্রথম আলোর একজন সাংবাদিক আমাদের বাড়িতে আসেন। ‘সন্তান বিক্রি’র গুজব সম্পর্কে তিনি সব কথা শোনেন। যাওয়ার আগে আমাকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। পরদিন থেকেই চিকিৎসক, নার্স, বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন আমার খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। দেশ–বিদেশ থেকে ফোন আসতে থাকে। সবাই আমাদের সাহায্য করতে চান। অনেকে বিকাশে আমাদের জন্য সাহায্য পাঠান। তখন জানতে পারি, প্রথম আলো পত্রিকায় আমাদের নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে।

তারপর সবকিছু স্বপ্নের মতো বদলে গেল। আমি চিকিৎসা পেলাম। আমার স্বামী রিকশা পেল, টাকা পেল। সন্তানেরা খাবার পেল, জামাকাপড় পেল, ভৈরবে একটা বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এল। প্রথম আলোর মাধ্যমে আমাদের সন্তানকে দত্তক নেওয়া দম্পতির খোঁজ পেলাম। তাঁদের সঙ্গে এখন যোগাযোগ হয়। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়। এখন আর আমার সন্তানদের ক্ষুধার্ত থাকতে হয় না। আমার বড় মেয়েটাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি। বড় ছেলেকে আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করব। যারা ভেবেছিল আমি সন্তান বিক্রি করেছি, পত্রিকায় খবর ছাপানোর পর তারাও সত্য জেনেছে। একটা সংবাদ প্রকাশের পর সবকিছু একদম স্বপ্নের মতো বদলে গেল।

অনুলিখন: গোলাম রাব্বানী, সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ