একটি জাদুকরি মুহূর্ত

প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা প্রকাশ করছি দেশে–বিদেশে থাকা আমাদের পাঠকের লেখা। তাঁরা লিখেছেন তাঁদের নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্য অভিজ্ঞতার গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

প্রতিদিনের মতো সেদিনেও ভীষণ ভিড় ঠেলে বাসে উঠেছি। রাস্তায়ও ভীষণ যানজট। বাস বাড্ডা পেরোতে সে ভিড় ঠেলে আরও কিছু যাত্রী উঠলেন বাসে। তাঁদের মধ্যে একটি কিশোরী আর একজন বয়স্ক নারীও রয়েছেন। বাসের গেটের কাছে অসম্ভব ভিড়। তাঁরা বাসের মধ্যভাগে এসে দাঁড়ালেন।

বাস ছেড়েছে। এর মধ্যে শুরু হলো এক যাত্রীর অবিরাম বকবক। একে তো ভিড়, তার ওপর প্রচণ্ড গরম। জানালার কাচ ভেদ করে তীব্র রোদের ঝলকে এক অসহ্য অবস্থা। বিরক্তিকে পাশ কাটাতে ইয়ারফোনে গান শুনতে শুরু করলাম। সেই পরিস্থিতিকে সহনীয় করা ইয়ারফোনের অসম্ভব হয়ে পড়ল।

লোকটা বকবক করেই চলেছে। এই ভয়াবহ গরমে পাবলিক বাসে কোনো মানুষ কীভাবে এত কথা বলতে পারে। গানের ভলিউম একেবারে ওপরে উঠিয়ে দিলাম। তা–ও বাঁচোয়া! কথার আওয়াজ পুরোপুরি দূর করতে না পারলেও অন্তত খানিকটা ঝাপসা করে তো দেওয়া গেল।

বাস ততক্ষণে গুলশান ছাড়িয়ে মহাখালীর পথে। পরের স্টপেজে আমার পাশের সিটের এবং সামনের দুই সিটের যাত্রীরা নেমে গেলেন। কিশোরী মেয়েটি আমার পাশে বসল। বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসলেন সামনের সিটে। তাঁর পাশে ওই বকবক করা ছেলেটি। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে উঠতে লাগল।

ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়াল। আমার পাশে বসা কিশোরী মেয়েটিকে তার সিটে ভদ্রমহিলাটির পাশে বসতে বলল। মেয়েটি মোটেই বসতে চাইছে না। তবু সে জোরাজুরি করেই চলেছে। আমার মনে বিরক্তি তখন চূড়ান্ত। সামান্য এই সিট বদলের জন্য কাউকে এতটা ত্যক্ত করার কারণ বুঝতে না পেরে ইয়ারফোনটা খুললাম।

কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, মেয়েটি এই ছেলের ছোট বোন আর ভদ্রমহিলা তার মা। মাকে ডাক্তার দেখাতে বা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনিয়েছিল। এখন তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। ছেলেটি তাই সিটের পাশে দাঁড়িয়ে ছোট বোনকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে পড়াশোনার কথা। মাকে বোঝাচ্ছে ঠিকমতো ওষুধ খেতে আর নিজের যত্ন নিতে।

বাস মহাখালী পেরোচ্ছে। যাত্রীদের নামার প্রস্তুতি নিতে তাগিদ দিচ্ছেন বাসচালকের সহকারী। ছেলেটিকে এবার নামতে তবে। ছোট বোনের মাথায় চুমু খেয়ে, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে পেছন ফিরে বেশ কয়েকবার বিদায় জানিয়ে নেমে গেল বাস থেকে।

অসম্ভব অনুতপ্ত বোধ করছি আমি। এরই মধ্যে জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ। ছোট বোনের জন্য চিপস কিনে এনেছে ছেলেটা। চিপসটা দিয়ে চলে গেল। মা আর বোনের সঙ্গে আমিও ছেলেটাকে জানালার বাইরে খুঁজছি।

বাসটা আবার যাত্রীতে ঠেসে গেছে। চালক হালকা চালে এগোতে শুরু করেছেন। পথের ভিড়ে ছেলেটিও চোখ মুছে বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। সুন্দর হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে মা আর ছোট বোনকে। যেন কিছুই হয়নি। বাস মহাখালী রেলগেট পেরিয়ে খানিকটা পথ এগিয়ে গেল। পেছন ফিরে দেখি, স্থির দৃষ্টিতে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা।

অচেনা সেই ছেলের সঙ্গে আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না। কিন্তু সারা জীবনের জন্য সে আমার জীবনে একটা জাদুকরি মুহূর্ত উপহার দিয়ে গেল।