কাজের মধ্যে থাকতে চান মান্নান

প্রথম আলো নিয়ে ছুটছেন মান্নান ব্যাপারী

২০১৩ সালের ১৬ মার্চ। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পত্রিকা বিক্রি শেষে নছিমনে চড়ে শহরে ফিরছিলেন হকার মান্নান ব্যাপারী। শহরের রানীগঞ্জ এলাকায় নছিমন থেকে পড়ে গেলে বাঁ পায়ের হাঁটু ভেঙে যায় তাঁর। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ভর্তি করেন দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৪ দিন পর মান্নানকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পায়ের অস্ত্রোপচার হয়। তিন মাস পরে বাড়ি ফেরেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন এখনো। ছেড়ে যাননি হকারের পেশা।

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার রাজারচর এলাকার বাসিন্দা মান্নান ব্যাপারী। নিজের বয়স বলতে পারেন না। জানালেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে দিনাজপুর শহরে ছিলেন। পরদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। অনুমান করে বলেন, ওই সময় বয়স ১৮ কি ১৯ হবে। সে হিসাবে তাঁর বয়স ৬৭–৬৮। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে মানুষকে তথ্য জানানোর কাজ করে যাচ্ছেন তি‌নি।

বয়সের ভারে খানিকটা ঝুঁকে হাঁটেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে পায়ের সমস্যা। আধা পাকা দাড়িমুখে লিকলিকে লম্বামতো মান্নান ব্যাপারীর মুখে লেগে থাকে পান–সুপারি। চোখেমুখে ও শরীরে কিছুটা ক্লান্তির ছাপ। কথা শুনে তা বোঝার অবকাশ নেই। ১৬ বছর বয়সে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় অভিমান করে রাজারচর থেকে দিনাজপুর শহরের ফকিরপাড়া এলাকায় আসেন মান্নান। এখানে তাঁর খালুর বাড়ি। খালু ভাঙারির ব্যবসা করতেন। খালাতো বোনের স্বামীর পেশা ছিল দাঁতের মাজন বিক্রি। বাস টার্মিনাল, হাটবাজার, বিভিন্ন মেলায় গিয়ে মাজন বিক্রি করতেন। সপ্তাহখানেক পরে দুলাভাইয়ের সঙ্গে মাজন বিক্রি করতে যান দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তনগর মেলায়। শুরু হলো হাতেখড়ি। চলন্ত বাসে চেপে দাঁতের মাজন আর কাশির ওষুধ বিক্রি শুরু করলেন। আয় বাড়তে থাকল। খালার সংসারেও জোগান দিতে থাকলেন।

এরপর দুই বছর কেটে গেছে। নিজ এলাকায় ফিরে বিয়েও করেছেন। দুই মাস যেতে না যেতেই আবার দিনাজপুরে ফিরে একই কাজ শুরু করেন। একদিন সকালে সৈয়দপুর বাস টার্মিনালে এক পত্রিকা হকারের সঙ্গে আলাপ হয় মান্নানের। হকারের কাছে জানতে পারেন পত্রিকা ব্যবসার খুঁটিনাটি। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। এজেন্টের কাছে গিয়ে পাঁচ কপি পত্রিকা নেন। দশমাইল এলাকায় আসতেই পত্রিকা বিক্রি শেষ হয়ে যায়। এবার মাজন-কাশির ওষুধের সঙ্গে যোগ হলো পত্রিকা।

১৯৯০ সালের কথা। দিনাজপুরে তখন পত্রিকা আসত বিআরটিসি বাসে। পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটা-নয়টা। এজেন্ট আমিনুল ইসলাম বলেন, অপেক্ষা করতে করতে এমনও গেছে গভীর রাতে পত্রিকা এসেছে। এর মধ্যে হকাররাও চলে গেছেন। পরদিন সকালে সেই পত্রিকা বিলি করতেন হকাররা। সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিলেন মান্নান। সৈয়দপুরে তখন বিমানযোগে পত্রিকা আসত দুপুরেই। মান্নান যেহেতু সকালের বাসে চড়ে সৈয়দপুরে যেতেন, পত্রিকাটাও সকাল সকাল পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারতেন।

এভাবে মাসখানেক চলল। মান্নানের পাঠকসংখ্যা বাড়ল। সেই সঙ্গে দিনাজপুরের এজেন্টদের পত্রিকা বিক্রি কমতে থাকল। পরে এজেন্টরা পত্রিক মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে সৈয়দপুর থেকে পত্রিকা নেওয়া শুরু করলে রুট বদলান মান্নান। এবার স্থানীয় এজেন্টদের কাছে পাইকারিতে পত্রিকা নেওয়া শুরু হলো। মাজন আর কাশির ওষুধ বাদ দিয়ে শুরু হলো পত্রিকা, বই আর সাময়িকী বিক্রি।

দিনাজপুর-দশমাইল-পার্বতীপুর রুট ছিল মান্নানের ব্যবসার এলাকা। এর মধ্যে দশমাইল এলাকায় একটি দোকান দিয়েছেন। পরে হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। কিছু টাকা জমিয়ে শহরের রাজবাটী এলাকায় পাঁচশতক জমি কিনেছেন। ছয় কক্ষবিশিষ্ট আধা পাকা বাড়িও তুলেছেন। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর হাতে গোনা কয়েকবার মাদারীপুরে গিয়েছেন তিনি। বছর দেড়েক আগে স্ত্রী মারা যান মান্নানের। দুই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পরে এমনিতেই কিছুটা ভেঙে পড়েছেন। তার ওপর স্ত্রীর মৃত্যুশোক। ছোট মেয়ের জামাইকে এখন নিজ বাড়িতে রেখে একসঙ্গেই থাকছেন মান্নান।

১৯৯৪ সালের দিকে ১০-১২ জনকে নিয়ে দিনাজপুরে হকার্স ইউনিয়ন গঠন করা হয়। তিনি হন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। দুই বছর পর সভাপতি নির্বাচিত হন। এভাবে ১০ বছর হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর হাত ধরে অনেকেই এই পেশায় এসেছেন।

মান্নান জানান, করোনার আগেও দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার শ পত্রিকার গ্রাহক ছিল তাঁর। আয় ছিল ভালোই। কিন্তু পত্রিকা ব্যবসায় আগের দিন আর নেই। দুই শ পত্রিকা বিক্রি করতে পারেন।

বয়স বাড়লেও খুব সকালে এজেন্টের দোকানে আসা ভোলেননি। যত দিন পত্রিকা বিক্রি করতে পারবেন, প্রথম সকালে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চান তিনি। দুপুরে সুযোগ বুঝে হোটেলেই খেয়ে নেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি একটু ভোজনরসিক মানুষ। তারপরও যা আয় হয় নিজে চলি। সংসারের খরচ করি। একা মানুষ, কত আর লাগে? একটাই চাওয়া, যেন শেষ দিন পর্যন্ত কাজের মধ্যে থাকতে পারি।’