কারাগারেও আমি ছিলাম প্রথম আলোর আপা

কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় রোজিনা ইসলামকে
ছবি: সাজিদ হোসেন

কারাবাসের এক দিন পার হয়ে গেল, এখনো কোনো খবর পাচ্ছি না। অসহ্য লাগছিল সবকিছু। মেঝেতে কম্বল দিয়ে বানানো বিছানার পাশে ‘যুগান্তর’ পড়ে আছে। তাতে বিভিন্ন পাতার গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো কেটে পড়তে দেওয়া হয়েছে। তবে ‘প্রথম আলো’ পড়তে পারলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতাম, কিন্তু কারাগারে ‘প্রথম আলো’ রাখা হয় না।

এর মধ্যে পারভীন (অভিজ্ঞ কয়েদি, আমার সঙ্গে যাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল) রেডিও কানে নিয়ে এসে বললেন, ‘প্রথম আলোর আপা, শোনেন রেডিওতে আপনার খবর বলতেছে। কারাগারের সবাই শুনতেছে।’

কারাগারের সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে রেডিওর খবর শোনেন। বন্দীদের অঢেল সময়। এখন টেলিভিশনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু বিটিভি দেখা যায়। আমার জন্যও আনা হয়েছিল, কিন্তু জ্যামার থাকায় সেটা আর চালু করা সম্ভব হয়নি।

রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দেওয়ার পর শুনলাম, এক পাঠক প্রশ্ন করছেন যে আমাকে কেন সাত ঘণ্টা আটকে রাখা হলো, কেন দুর্নীতির খবর লেখার কারণে আমাকে কারাগারে নেওয়া হলো, এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বিবিসি বাংলার এক সাংবাদিক নানা রকম যুক্তি দিয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

রেডিও শুনতে আমার ভালো লাগছিল না, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মেয়েটার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে সেই সময়। কোথায় কী হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কাকে বলব, কাকে বোঝাব। হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল, প্রেশার নেমে গেল। দুজন চিকিৎসক এলেন খবর পেয়ে। ঘুমের ওষুধ দিলেন, অনেক গল্প করলেন। তারপর চুপিসারে বললেন, ‘প্রথম আলো’ তাঁদের প্রিয় পত্রিকা। আরও বললেন, সেদিন ‘প্রথম আলো’য় আমাকে নিয়ে কী কী সংবাদ ছাপা হয়েছে, কে কী বলেছেন, কোথায় প্রতিবাদ হয়েছে, বিশ্ব মিডিয়া কী লিখছেসহ নানা কিছু। দুই চিকিৎসক যখন ‘প্রথম আলো’র একটার পর একটা খবরের শিরোনাম বলছিলেন, আমি আমাদের ১২ তলার সংবাদকক্ষ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মনশ্চক্ষে দেখছিলাম, সম্পাদক বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের নিয়ে মিটিং করছেন। প্রতিবেদকেরা ছোটাছুটি করছেন, প্রধান প্রতিবেদক কথা বলছেন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন শিশিরদার (শিশির মোড়ল) পাশে আমার নিজের আসনে বসে আছি, প্রাণের ‘প্রথম আলো’তে।

ধীরে ধীরে মন কিছুটা শান্ত হলো। দুই চিকিৎসক জানালেন, কারাগারের সবাই জেনে গেছেন ‘প্রথম আলো’র এক আপা এখানে এসেছেন। তাঁরা সবাই আমাকে দেখতে আসতে চাইছেন। চিকিৎসকেরা জানালেন, বাসায় তাঁরা ‘প্রথম আলো’ পড়েন। আর পড়েন বলে তাঁরা আগে থেকেই আমাকে চেনেন।

এত হেনস্তা, এত কষ্ট, এত সংগ্রাম ও অস্বস্তির মধ্যে যখন আমাদের প্রিয় পত্রিকা নিয়ে তাঁদের মুখে এসব শুনছিলাম, মনটা ভরে গিয়েছিল। যে কদিন ছিলাম কারাগারে, প্রতিদিনই ওই দুই চিকিৎসক হাতের তালুতে লিখে নিয়ে এসে জানাতেন, সেদিন ‘প্রথম আলো’য় আমার বিষয়ে কী কী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

এখন যেমন করে সেদিনের ঘটনা বলছি, তখন মন এত স্থির ছিল না। তবে যখন জানতে পেরেছি, ‘প্রথম আলো’সহ সবাই আমার পাশে আছেন, সে সময় কিছুটা শান্তি পেয়েছি, বুকে বল পেয়েছি।

দুই দিন পার হতেই জেল সুপার বলেই ফেললেন, ‘“প্রথম আলো”র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক যত দিন কারাগারে থাকবেন, তত দিন আমি ঘুমাতে পারব না। কারাগারে কোনো ত্রুটি হলে “প্রথম আলো” ঠিকই লিখে ফেলবে।’ আরেকটা তথ্য না দিলে নয়, এই জেল সুপার যখন রাজশাহীতে ছিলেন, তখন একটি তদন্ত প্রতিবেদন ধরে তাঁর অনিয়ম নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলাম আমি। সেটা কাশিমপুর মহিলা কারাগারের সবাই জানতেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, এ জন্য হয়তো আমাকে অনেক বেগ পেতে হবে। কিন্তু আমি ‘প্রথম আলো’র সাংবাদিক বলেই আমাকে নিয়ে তাঁরা নিজেরাই কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন। এর মধ্যে কয়েদি পারভীন খবর নিয়ে এলেন, ক্যাসিনো–কাণ্ডে আটক পাপিয়া, সাবরিনা আমাকে সালাম জানিয়েছেন। পাপিয়াকে নিয়ে আমি তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছিলাম। তারপরও আমাকে তিনি সালাম জানিয়েছেন, শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম।

ছয় দিন পর যখন মুক্ত হলাম, জামিনের কাগজ তখনো আসেনি। জেল সুপার আমাকে কারাগার দেখাতে নিয়ে গেলেন, শরীর চলছিল না, তবু মনে হলো, আমাকে দেখে যেতেই হবে পুরো কারাগার, এটা আমার জন্য অভিজ্ঞতাও বটে।

কারাগার থেকে বের হয়ে আসছি, এমন সময় দেখলাম বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা একজন দাঁড়িয়ে আছেন। কারারক্ষী বললেন, ‘আপা, আপনাকে দেখার জন্য উনি দাঁড়িয়ে আছেন।’ আমি ভাবলাম, এত সুন্দর মেয়েটা কে? জেল সুপার জানালেন, তিনি সাবরিনা। আপনি বোধ হয় তাকে নিয়েও প্রতিবেদন করেছিলেন। মনে হলো, ওহ্‌ তাই তো, রিজেন্টের ঘটনার সঙ্গে ওই চিকিৎসকও তো যুক্ত ছিলেন।

জেল থেকে বের হওয়ার আগে জেল সুপার বললেন, ‘“প্রথম আলো”র প্রতিবেদন সবাই বিশ্বাস করে, তাই বাইরে গিয়ে এমন কিছু বলবেন না, যাতে আবার আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়। আমার চাকরি নিয়ে সমস্যা হয়। স্যার বারবার বলেছেন, “প্রথম আলো কিন্তু, সাবধান!”’

পারভীন, মালা, ইতি ও অন্য অনেক বন্দী আমার পেছন পেছন এল সেদিন, ফটকের কাছে এসে আর এগোতে পারল না। অগত্যা একসঙ্গে সবাই–ই বলল, ‘বিদায়, প্রথম আলোর আপা।’

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসলে মনে মনে তখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম ‘প্রথম আলো’র প্রতি, এ পত্রিকায় কাজ করি বলেই তো কারা কর্মকর্তা থেকে কয়েদি—সবার কাছেই আমি প্রথম আলোর আপা।
লেখক: হেড অব ক্রাইম রিপোর্টিং