সংস্কৃতির কালান্তর

আবুল মোমেন

সংস্কৃতির আলোচনায় সমাজের কথা ওঠা স্বাভাবিক। সমাজই সংস্কৃতির নির্মাতা, ধারক ও বাহক। সমাজ কখনো ধীরে, কখনো বেশ দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়, কখনো এই পরিবর্তন একরৈখিক হলেও প্রায়ই তা বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। দেশভাগের পরে পাকিস্তান আমলে, মোটাদাগে যাকে বলা যায় প্রগতির ধারা, সেই পথে সমাজের প্রভাবক অংশ চলেছিল। রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ক্রমে এই ধারা চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছিল বলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের দলিলে ও পরে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে বোঝা গেল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মধ্যে প্রগতির ধারা হয়েছিল প্রবল এবং তখন সমাজের ভিন্ন ধারাগুলো কার্যত নগণ্য হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু প্রতিপক্ষের পরাজয়ের পরে দেখা গেল প্রগতির ধারা সমাজের একক বা প্রভাবক স্রোত হয়ে আর টিকতে পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে প্রগতির যেমন অনেক হঠকারী বিপ্লবী স্বর শোনা যাচ্ছিল, তেমনি প্রতিক্রিয়ারও কিছু চরম কণ্ঠ স্পষ্ট হতে শুরু করে। তবে গত শতকের সত্তর দশকের শেষ দিকে একদিকে সামরিক শাসকদের একনায়কি শাসনের চাপে ও অন্যদিকে রাজনীতিতে আদর্শবাদের অবসানের কালে আরও নানা সূত্রে সামাজিক অঙ্গনে পরিবর্তনের বহুতর আলামত দেখা দিতে শুরু করে।

গত শতকের আশির দশক থেকে সমাজে এমন সব সুযোগ বা চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছিল, যেগুলো সংস্কৃতির চেতনা ও চর্চা—দুই ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের ও রূপান্তরের ক্ষমতা রাখে। দেখা যায় পরিবর্তন অনিবার্য হলেও সংস্কৃতিজগতের সনাতন ভাবনা ও প্রচলিত অভিভাবকত্ব এ পরিবর্তন মানতে পারে না। আবার কোন ভাবনা ও প্রকরণ ধ্রুপদি, আর কোনটি ছিল নিছক সমকালীন, এখন তামাদি, তা বোঝা কঠিন। এ নিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে সিদ্ধান্ত দেওয়া আরও কঠিন। কারণ, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রক্ষণশীল মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

দুই.

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের অনুঘটক কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার।

ক. আশির দশক থেকে গ্রামের ঘরনি, কন্যারা গৃহস্থালির গণ্ডি ছেড়ে দলে দলে শহর-শহরতলিতে তৈরি পোশাক কারখানার ‘স্বাধীন’ শ্রমজীবীর জীবিকা গ্রহণ করেছেন। আর গ্রাম্য নারীর স্বাধীন চাকরির চরম রূপ বোধ হয় অভিবাসী শ্রমজীবীর ভূমিকায় অজানা বিদেশে পাড়ি দেওয়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। নারীই বরাবর বাঙালির গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রাণভোমরা, তাই আরও কিছু কারণের সঙ্গে তাঁদের ব্যাপক হারে এই ভূমিকা বদল মিলে এতে ভাটার টান এসেছে। খ. আগের দশক থেকেই গ্রামের নিম্নবর্গের মেহনতি মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে অভিবাসী শ্রমজীবী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের ঊষর আরব মুসলিম বিশ্বে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁদের সংখ্যাও কেবল বেড়েছে এবং তা এখন দেড় কোটির বেশি হবে। তাঁরা বাংলার গ্রামে আরবের পোশাকি সংস্কৃতি আমদানি করলেন, বিশেষত মুসলিম নারীর জন্য। গ. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, জিয়ার উত্থান ও ইরানে ইসলামি বিপ্লব—এ তিন ঘটনা দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কট্টর থেকে উদার সব ধারার উত্থানে সহায়ক হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত রাজনীতিও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময়ে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। ঘ. নব্বইয়ের দশক থেকে মুক্তবাজার ও বিশ্বায়নের অর্থনীতির পালে লেগেছে হাওয়া। এই ধারার বাইরে থাকা আমাদের মতো দেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এতে সংস্কৃতি, শিক্ষাসহ সবকিছুর পণ্যায়ন, মানুষ হয়ে উঠেছে ভোক্তা। ঙ. ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তার প্রতিবাদ ষাটের দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে হয়তো প্রকাশ পেত। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাম ধারার সেই রাজনীতি স্তিমিতপ্রায়। বিপরীতে এর প্রতিক্রিয়া এসেছে মূলত কট্টরপন্থী ইসলামি ভাবধারা থেকে। এই জোয়ারে ক্রমেই জোরদার হয়েছে ইসলামের জঙ্গিবাদী ধারা। চ. একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তিসহ কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যেন সর্বজয়ী যাত্রা শুরু হলো। এরই প্রভাবে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানবজীবনের নানা ক্ষেত্রে আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তি ও যন্ত্রের প্রসার।

তিন.

বাঙালি সংস্কৃতির যে প্রমিত নাগরিক রূপ এ দেশে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে সংস্কৃতির মূলধারা হিসেবে পরিচিত ছিল, তাতে এসব পরিবর্তনের ছোঁয়া যে লাগবে, তা সহজেই অনুমেয়। তখন সংস্কৃতির বড় উৎস ছিল গ্রামীণ কৃষিসমাজ। আজ ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবনের ধারা ও সনাতন কৃষি সংস্কৃতি অনেকটা তামাদি হয়ে পড়েছে। উৎপাদক মানুষকে ছাপিয়ে উঠেছে মানুষের ভোক্তা সত্তা।

তা ছাড়া এই গ্রামীণ সংস্কৃতির লালনকারী ছিলেন গ্রামের দরিদ্র নারীরা। এঁদের অধিকাংশ নতুন বাস্তবতায় স্থানান্তরিত বা ক্ষুদ্রঋণের সূত্রে বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়েছেন। সব মিলিয়ে সংস্কৃতিচর্চা ও সৃষ্টিশীলতা গেছে স্তিমিত হয়ে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির চাপের মুখে প্রমিত নাগরিক সংস্কৃতিচর্চার প্রধান কুশীলব শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-তরুণসমাজও বিপর্যয়ের মুখে প্রগতিশীল চেতনা আগলে রাখতে পারেননি। ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও মুখস্থ-পরীক্ষা-সনদনির্ভর শিক্ষা সংযোগ হারিয়েছে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে। নতুন বাস্তবতায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার এবং তাদের বানিয়ে ছেড়েছে পণ্যে।

এরই মধ্যে নতুন প্রজন্মের সচেতন একটি অংশ হয়ে উঠেছে দ্বিভাষী। বৈশ্বিক পরিসরের আহ্বান শুনতে পেয়েছে তারা। তবে পরিবার ও বিদ্যালয়ে সংস্কৃতিচর্চার অভাবে তারা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস বা সাহিত্য-শিল্পে আগ্রহ, জ্ঞান ও বোধের ঘাটতি, অক্ষমতা ও বিভ্রান্তি নিয়ে বড় হচ্ছে। অনেকে এই আলামতগুলো দেখে তাঁদের সনাতন সংস্কৃতিচিন্তা থেকে চরম হতাশা ব্যক্ত করে থাকেন। তবে এ হলো ব্যাপক বহুমাত্রিক পরিবর্তনের এক হযবরলপূর্ণ বাস্তবতা। তাই এর মধ্যে যে সৃষ্টির সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে, তা পর্যবেক্ষণ করে তাকে স্বাগত জানাতে হবে।

প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি—তিন ক্ষেত্রে পরিবর্তন অনিবার্য। তেমনি মানুষের, বিশেষত তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতা, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আগ্রহ ও সামর্থ্যের কখনো অভাব ঘটে না। পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুনের আবির্ভাব ঘটে। সত্যিই যা শাশ্বত, পরিবর্তনের জঙ্গমতায় তা কিছুকাল চাপা পড়লেও আবার ফিরবে—হয়তো তার রূপ, তাৎপর্য, প্রভাব ইত্যাদিতে ছাপ পড়বে পরিবর্তনের।

লেখক: সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী