প্যারিসে হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা।
ছবি: সুমন ইউসুফ

সময়টা ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করায় সেখানে এক মাসের জন্য একটি আবাসিক প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ পাই।

বিষয়টি আমার সম্পাদক মতিউর রহমানকে জানাই। তিনি আনন্দিত হয়ে আমাকে এক মাসের ছুটি দিয়ে দিলেন। ছুটিটা যেহেতু ব্যক্তিগত, তাই অফিসের ক্যামেরা অফিসের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আমার ব্যক্তিগত ক্যামেরা নিয়ে উড়াল দিলাম প্যারিসের উদ্দেশে।

মিউজিয়াম আর বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখতে দেখতে প্যারিসে বেশ ভালোই সময় কাটছিল আমার। ঠিক ১৩ নভেম্বর প্যারিস শহরে ঘটে গেল এক নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা। হামলাকারী আইএস। শতাধিক মানুষ নিহত হন এ হামলায়। এ ঘটনা ঘটিয়েছিল ইসলামিক স্টেট মানে আইএস। জঙ্গি সংগঠনটি পরে এ হামলার দায় স্বীকার করে।

ছবি তুলে অফিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রাতেই আমাদের ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান জিয়া ইসলামকে মেসেঞ্জারে ইনবক্স করে রাখলাম যে আমি ছবি পাঠাচ্ছি। পরদিন ভোরবেলা বের হয়ে গেলাম। বাংলাদেশে তখন গভীর রাত। আমি যখন প্লাস দ্যো লা রিপাবলিকে ছবি তুলছি, হঠাৎ আমার ভাইবারে ফোন বেজে উঠল। পল্লব মোহাইমেনের ফোন। ছবি পাঠাতে বললেন। এর কিছু বাদেই ভাইবারে আবার মেসেজ এল ‘আমরা আপনার তোলা ছবিই ছাপাব’। কামাল (কামাল আহমেদ) ভাইয়ের মেসেজ।

যাহোক, আমি সারা দিন ছয়টি হামলার স্থান ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বিকেলের দিকে অফিসে ছবি পাঠিয়ে দিলাম। পরদিন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আমার তোলা ছবি এবং প্রতিবেদন ‘রক্তাক্ত প্যারিস, স্তম্ভিত বিশ্ব’ শিরোনামে ছাপা হলো।

এক সন্ধ্যায় প্যারিসের সবচেয়ে বড় চার্চ নটর ডেম ক্যাথেড্রালে হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে প্রায় ১০ হাজার মানুষের এক প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ছিল খুব কড়াকড়ি। সবাইকে খুব তল্লাশি করে চার্চে ঢুকতে দিচ্ছিল। আইডি কার্ড ছাড়া প্রেসের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না।

আমার প্রেস কার্ড বলতে শুধু প্রথম আলো। আমাকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মঁসিয়ে, হয়ার ইজ ইয়োর প্রেস আইডি কার্ড?’ আমি প্রথম আলোর কার্ড দেখালাম। বাংলা লেখা দেখে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ‘নো নো মঁসিয়ে, উই অ্যালাউ অনলি ইংলিশ আইডি কার্ড’। আমি সঙ্গে সঙ্গে কার্ডের উল্টো দিকে ইংরেজিতে লেখা প্রেস অংশটা দেখিয়ে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘আই এম ফ্রম দ্য হাইয়েস্ট সার্কুলেটেড বেঙ্গলি ডেইলি নিউজপেপার প্রথম আলো ইন মাই কান্ট্রি বাংলাদেশ।’ সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তাটি হাসিমুখে আমাকে চার্চে ঢুকতে দিলেন।

এর কিছুদিন পর মতি ভাইয়ের নির্দেশ পেলাম যে পুরো এক দিন প্যারিস শহর ট্যাক্সি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি ও স্টোরি সংগ্রহ করার জন্য। ছুটির দিনের প্রচ্ছদ আয়োজন করা হবে। এক দিনের ট্যাক্সি ভাড়া ও খাবার খরচ অফিস থেকে আমাকে দেওয়া হবে। আমি বেরিয়ে পড়লাম।

ল্যুভে মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, সেন্টার পম্পিদ্যু, প্ল্যাস দ্যো লা রিপাবলিক, বাতাক্লান সেন্টার, নটর ডেম ক্যাথেড্রাল, স্টেডিয়াম, গ্যাঁ দ্যু নর্দ, লা শাপেলসহ হামলার যত স্থান এবং পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে ঘুরে তোলা ছবি ও প্রায় পনেরো শ শব্দের একটা ফিচার পাঠিয়ে দিলাম অফিসে। পরের শনিবার ছুটির দিনের প্রচ্ছদ আয়োজন হিসেবে ছাপা হলো আমার ছবি ও লেখা। শিরোনাম ছিল: থমকে যাওয়া প্যারিসের ডায়েরি।

ঢাকায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মতি ভাইয়ের কথামতো অফিস থেকে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো একদিনের ট্যাক্সি ভাড়া ও খাবার খরচের অর্থ। শুধু তাই নয়, এর বেশ কিছুদিন পর ‘থমকে যাওয়া প্যারিসের ডায়েরি’ লেখার জন্য আমার বিভাগ থেকে বিশেষ সম্মানীসহ একটা প্রশংসাপত্রও পেলাম।

২০১৬–তে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার এক বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের ফরাসি দূতাবাস ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে আমার তোলা ছবিগুলো দিয়ে। শিরোনাম ছিল: নভেম্বর ইন প্যারিস। সেই প্রদর্শনীতে তাঁরা বিশেষ অতিথি করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে। আমার প্রথম আলো জীবনে প্যারিস ট্যুর এভাবে বড় একটি অর্জন হয়ে গেল।

সুমন ইউসুফ: জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক, ফিচার