উচ্চশিক্ষার ভ্রান্তিগুলো

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাচিত্রে গত ৩০ বছরে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেসবকে বৈপ্লবিক বলা যেত, যদি তাদের যোগফল শিক্ষাচিত্রটিকে সত্যিকারভাবে উজ্জ্বল এবং প্রশংসনীয় করতে পারত। সেই লক্ষ্যে কিছু পরিবর্তন যে সূচিত হয়নি তা নয়; কিন্তু ব্যাপক অর্থে এই ৩০ বছরের পরিবর্তন উচ্চশিক্ষাকে একুশ শতকের জন্য উপযোগী করতে, বৈশ্বিক মাপে এর শিক্ষাক্রম, গবেষণা ও পাঠদানকে উত্তীর্ণ করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেগুলো নেওয়া হয়নি। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন শিক্ষার যে রূপরেখা তৈরি করেছিল, তা গৃহীত ও অনুসৃত হলে হয়তো যাত্রাটা আমাদের শুভ হতো, তা হয়নি। 

প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক—কোনো পর্যায়েই দীর্ঘদিন আমরা এমন কোনো সংস্কার করতে পারিনি, যা এ তিন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এমন মান, সক্ষমতা, গণিত ও ভাষাগত দক্ষতা তৈরি করে দেবে যে উচ্চশিক্ষাকেও তাদের প্রত্যাশা ও সক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি হতে হবে। নিম্নপর্যায়ের ভাষাদক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, যোগাযোগ ও জীবনদক্ষতা এবং সংস্কৃতিমনস্কতা নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী (মোট শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ) উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে, তারা না পারে এই শিক্ষার সবটুকু গ্রহণ করতে, না পারে তাদের অবদানে এই শিক্ষাকে আরও গতিশীল করে সামনে এগোনোর প্রয়োজনীয়তা তৈরি করতে।

উচ্চশিক্ষাসহ শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে অর্থ বিনিয়োগ করি, তা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সর্বনিম্ন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন ও স্বীকৃতি এতই কম যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চান না। যে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা করপোরেট বাজারের ব্যবস্থাপক ও সরকারি প্রশাসক তৈরির একটি উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, সে দেশে বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, গবেষক, চিন্তাবিদ ও পরিবর্তন নিশ্চিতকারীর সংখ্যা হতাশাজনকভাবেই কম থেকে যায়। এই ভুল ব্র্যান্ডিং উচ্চশিক্ষায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।

নৈরাজ্য কথাটি কিছুটা হলেও আমাদের উচ্চশিক্ষায় প্রয়োগ করা যায়। এ মুহূর্তে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ, যা বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না, জানি না। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এরা যে শিক্ষা দেয়, তাকে বিশ্ব দূরে থাকুক, দেশীয় মানেও নিম্ন থেকে মাঝারি পর্যায়েরই বলা যায়। শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে আশ্চর্যজনকভাবে কমসংখ্যক বিষয়ে এবং প্রায় সবই বাজার–সমর্থিত। বাজারের সূত্র মেনেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—কিছু ব্যতিক্রম বাদে—ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চরিত্র নিয়েছে। 

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত বাজারবান্ধব বিষয় পড়ায় না, তবে এখন তাদের সেই দিকে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চরিত্র অনেকটাই ধরে রেখেছে। তবে যে নৈরাজ্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে জন–আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কার্যকর হতে দিচ্ছে না, তার উৎসগুলো অন্যতর। এর একটি প্রয়োজনের তুলনায় কম বিনিয়োগ। দ্বিতীয়টি শিক্ষকরাজনীতি ও তৃতীয়টি নৈরাশ্যজনক ছাত্ররাজনীতি। 

ভিত্তি পর্যায়ের দুর্বলতা শিশুদের পরবর্তী স্তরের শিক্ষার অর্জন ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করে

কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসংকটে ভুগছে। বড় দু–এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যদের সাধ্য নেই একজন শিক্ষককেও বিদেশে উচ্চতর গবেষণার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে। ঢাকা থেকে যত দূরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, তত তার শিক্ষকসংকট। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানেও একজন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার মতো অপরাধ সংঘটনে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতিতে (কিছু গণমুখী সংগঠন ছাড়া) এখন কোনো আদর্শ নেই; যা আছে তা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতার হাত ধরে আসা বস্তুগত যত অর্জন।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য আছে শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে শিক্ষাজীবন শেষে বেকারত্বে ঠেলে দেওয়ায়; নৈরাজ্য তৈরি হয় অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে মাদক, উগ্রবাদ ও ভ্রান্ত ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়ায় এবং সংস্কৃতির সুস্থতা থেকে তারা বিচ্যুত হওয়ায়। ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসগুলো থেকে সংস্কৃতিকে তাড়িয়েছে। এ কাজে তাদের সহযোগী হয়েছে অন্য একটি বৃত্তে অবস্থান করা সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র চিন্তায় ক্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

তবে নৈরাজ্যের অপর পিঠেই সুস্থতা ও আশাবাদের উপস্থিতি। সেই উপস্থিতি যে আছে, তা যেন প্রকৃতির নিয়ম মেনেই—খরা কাটিয়ে বৃষ্টি আসা রাত শেষে ভোর হওয়ার মতোই। যদি আশাবাদের জায়গাটা না থাকত, শিক্ষকতাকে বিদায় জানিয়ে পাকাপাকি অবসরে যেতাম। আশাবাদের বড় জায়গাটা তারুণ্য। এরা বুঝতে পারছে, বিশ্বে টিকে থাকতে হলে সক্ষমতা অর্জনের বিকল্প নেই। সেটি আসতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, ভাষাদক্ষতায়, যোগাযোগে; এটি আসবে আত্মবিশ্বাসের পথ বেয়ে। 

আশাবাদের আরেক জায়গা হচ্ছে, মেয়েদের উচ্চতর হারে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করা। ফলিতবিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ অনেক অঞ্চলে এখন তাদের বিচরণ বাধাহীন। বেশির ভাগ এখন নিজের শর্তেই নিজেদের চলার পথটি মাপতে চায়। যত এ চর্চা বাড়বে, তত উচ্চশিক্ষার চিত্রটি উজ্জ্বল হবে। শিক্ষার্থীরা ভ্রষ্ট রাজনীতির বিকল্পও খুঁজে নিচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কম্পিউটারপ্রযুক্তি তাদের সহায়তা করছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। সংস্কৃতিও এখন হারানো ভূমিটা উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছে। গত চার–পাঁচ বছরে আমাদের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে আইটি আউটসোর্সিং, বাস্তুকলা থেকে নিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি—সর্বত্র যে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয়।

শিক্ষকরাজনীতি সত্ত্বেও শিক্ষকেরা একুশ শতকের জন্য তৈরি হচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে ও পরস্পরের সহায়তায় তাঁদের নিজেদের কাজটুকু করে যাচ্ছেন, একটু সহযোগিতা পেলেই তাঁরা আরও বেশি উদ্যোগী এবং সফল হবেন। দুটি চলমান বড় একাডেমিক উন্নয়ন–ভাবনায় আমি অংশ নিচ্ছি। এর একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিছু শিক্ষককে নিয়ে যে প্রকল্পটির সূচনা করেছেন, তার দায়িত্ব দিয়েছেন একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানীকে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের শিক্ষকের সঙ্গে বসেছি, তাঁদের কথা শুনেছি। যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে, ভূমিটা তৈরিতে একটু সহায়তা পেলে বাকিটা তাঁরা দেখবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তা–ই। কলেজের শিক্ষকেরাও ভালো কিছু করতে চান আমি নিশ্চিত, চিত্রটা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সর্বত্র। 

ভালো–মন্দের দ্বন্দ্বে ভালো জয়ী হওয়ার উদাহরণ আমাদের খুব বেশি নেই। কিন্তু দেশটা বাংলাদেশ বলেই ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, বিশেষত তরুণেরা যখন এর কেন্দ্রে থাকে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক