‘আল্লাহর কাছে যা চেয়েছি, পেয়েছি..’

শেখ মোকাদ্দেস আলী

কিছু একটা করতে হবে। সেই আকাঙ্খাটা ছিল তীব্র। তবে কী করবেন তা জানা ছিলনা। শুধু মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা ছিল, ‘বাড়ি থেকে আর কিছু নিবেন না।’ নিজে কিছু করবার সে প্রচেষ্টা থেকে বের হন ঘর ছেড়ে।

৩২ বছর আগে নিজ গ্রাম ছেড়ে বের হওয়া সেই তরুণের বয়স এখন ৫৭। মাত্র আড়াইশ টাকা নিয়ে বাগেরহাট শহরে আসা সেই তরুণ ১০ বছরের মাথায় কিনেছেন জমি, সেখানে তুলেছেন বসতঘর। উচ্চশিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন দুই মেয়েকে। লেখাপড়া করছে আরও তিন ছেলে-মেয়ে।

আর এর সবটাই শেখ মোকাদ্দেস আলী করেছেন সংবাদপত্র বিক্রির আয় থেকে। গেল তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাগেরহাট শহরে এজেন্ট হিসেবে পত্রিকার ব্যবসায় যুক্ত তিনি। এখনও প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেলে করে পত্রিকা পৌঁছে দেন পাঠকের বাড়ি বাড়ি। এইএসসিন পাশের পর ৯০’ সাল থেকে এই ব্যবসায় যুক্ত হন তিনি। প্রথম আলো বাজারে আসার কিছু দিন পর থেকেই বাগেরহাট শহরে পত্রিকাটির অন্যতম এজেন্ট তিনি।

মোকাদ্দেস আলী বলেন, ৯০-এর দশকের ঢাকা কাগজ আসত বিকেলে। আমি ব্যবসা শুরুর পর আস্তে আস্তে সাংবাদিকদের সাথে পরিচিত হলাম। তারাও আমাকে উৎসাহ দিত। আমিও দেখতাম পত্রিকা পড়ে জ্ঞানী-গুণি, শিক্ষিত মানুষ। তারা এসে বসত আমার দোকানে, ভালো লাগে। সেই থেকে এই ব্যবসায় আছি।

প্রথম থেকে প্রথম আলো পত্রিকাটা আমার ভালো লাগত। ১৫ কপি কাগজ দিয়ে আমার এজেন্সি শুরু। ৯৯’সালতে দিন দিন কাগজের চাহিদা বাড়তে থাকে। আমি নিজে থেকেই প্রথম আলোকে গুরুত্ব দিয়েছি। ব্যবসার দিক থেকেও সব সময় প্রথম আলোর কথা কাজে মিল ছিল। আমার নিজের অসুস্থতা, স্ত্রীর অপারেশন, সব সময় প্রথম আলো পাশে থেকেছে।

মোকাদ্দেস আলীর পৌত্রিক বাড়ি খুলনার রুপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে। তবে এখন তিনি বাগেরহাটের স্থায়ী বাসিন্দা। শহরের হাড়িখালী এলাকায় থাকেন নিজের জমিতে তোলা ঘরে।

মোকাদ্দেস বলেন, বেশ আগের কথা, একটা এনজিও থেকে বাগেরহাটের ৩০১টি স্কুলে দুই কপি করে প্রথম আলো পত্রিকা দেওয়া হত। বাচ্চারাও দেখতাম কি আগ্রহ নিয়ে পত্রিকা পড়ে। আমার তখন সব মিলিয়ে ভালো বিক্রি, ব্যবসা হত। আসলে ওই সময়টা প্রথম আলো আমাকে আগায় দিছে।

এই শহরে আমার কিছুই ছিলনা। ২৫০ টাকা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া থাকতাম। এই পত্রিকা বিক্রি দিয়ে আমার সব। পত্রিকা বিক্রির টাকা দিয়ে জমি কিনেছি, একটা ছোট ঘর তুলেছি। ৫ ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করাইছি।

তবে এত কিছু সহজ ছিলনা। বলেন, ‘তিন মাস বয়সে বাবা মারা যায়। ভাইদের কাছে বড় হইছি। নিয়মিত হাল চাষ করে তারপর পড়ছি, কলেজে গেছি। এইচএসসি পাসের পর ঢাকায় যাই। গার্মেন্টসেও কাজ করি। এদিকে ডিগ্রিতে ভর্তি হই। আবার পুলিশে চাকরি হয়। তবে এলাকার গ্যঞ্জামে সেই চাকরিতে যোগ দিতে পারিনা। তখনই কিছু করবো বলে বাড়ি থেকে হই।

তখন বড় বোনের দেওয়া ৯৫০ টাকা নিয়ে বের হইছিলাম। এক আত্মিয়ের মাধ্যমে শুনে এজেন্সি নিতে খুলনার একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার অফিসে দিতে হয় ৭০০ টাকা। বাকি টাকা আসি বাগেরহাটে।

‘পত্রিকার কি দিন দেখেছি। দুই টাকার কাগজ বিক্রি করেও অফিসে ৫০ হাজার টাকা বিল দিছি। তবে এখন আর সেই ব্যবসা নেই’ আক্ষেপ করে মোকাদ্দেস আলী বলেন, পত্রিকার পাশাপাশি করোনার শুরু থেকে বাড়ি গরু ছোট খামার করছি। ঘরটা এখনও ঠিক করতে পারিনি। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। কিন্তু আগে ছেলে-মেয়েদের খেয়াল করছি। ওদের পড়াইছি।

বড় মেয়ে স্বর্ণা (২৮) মাস্টার্স ও লতা (২২) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। আর মেঝ মেয়ে নূর জাহান ময়ণা (২০) মেডিকেল টেকনোলজির উপর ডিপ্লোমা শেষ করে বিএসসি পড়ছেন ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট মেয়ে মনোয়ারা মেঘলা (১৭) দশম শ্রেণিতে এবং ছেলে মোস্তফা শাহারিয়ার সূর্য (১৫) হাফেজি পড়ছে।

মোকাদ্দেস আলী প্রথম আলোকে বলেন, আমি ছেলে-মেয়েদের জন্য কোন সম্পদ করে রেখে যেতে পারিনি। তবে ওদেরকে সম্পদ করে রেখে যেতে চেষ্টা করেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ওদের লেখাপড়া করেতে পারছি। পরিবারের অন্যদেরও সাহায্য করতে চেষ্টা করি।

এখন প্রতিদিন নামাজ পড়ে ভোর ৬টার আগে গোয়ালে যাই। তার পর পত্রিকা দিতে বের হই। বাড়ি এসে আবার গরুর কাছে। এভাবে ভোর থেকে রাত ৮টা - ৯টা পর্যন্ত কাজ করি। এ সময় শুধু পত্রিকা দিয়ে আমাদের পুরো সংসার চলত।

 আমার পত্রিকার দোকান, হকার দিয়ে ১৮-২০ জনের রান্না হত প্রতি বেলায়। তাও ভালোই ছিল। তবে এখন পত্রিকার দিয়ে আর সংসার চলেনা। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনারও অনেক খরচ। গরু পালায় একটু সুবিধা হইছ। মাঝে দুটো বিক্রি করে মেয়েটাকে বিএসসিতে ভর্তি করছি। দুধ বিক্রি করে কিছুটা আগায়।

তিনি বলেন ‘চেষ্টা করলে কঠিনও সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ মানুষের প্রতি এত সদয় হয় আমি তা নিজেকে দিয়ে দেখেছি। অনেক বিপদ আইছে। ২০০০ সালে আমি অসুস্থ হইছি। ২০০৫ ও ১৮ সালে আমার স্ত্রী অসুস্থ্য হইছে। বড় বড় অপারেশ লাগছে। প্রতিবার আল্লাহ পার করে নিছে। আল্লাহর কাছে যা চেয়েছি, পেয়েছি। শুকরিয়া করি।’