আমি সাংবাদিক নই, একজন ফেরিওয়ালা

ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি টুকটাক ঝোঁক ছিল। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে পড়ার সময় এই ঝোঁকটা খানিকটা বড় হতে থাকে। বই পড়ারও হালকা-পাতলা নেশা ছিল। তবে উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন মনে উঁকি দিতে থাকে। সেই থেকেই স্বপ্ন শুরু।

১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। সেই সময় মা–বাবা, ভাই-বোন ও বন্ধুবান্ধবের কথা একরকম অগ্রাহ্য করেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই। সাংবাদিকতায় পড়ার সুবাদে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকা পড়া নেশা হয়ে দাঁড়ায়। পত্রিকা পড়তে পড়তে কখন যে প্রথম আলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি, নিজেও টের পাইনি।

একপর্যায়ে প্রথম আলোর প্রেমে পড়ে যাই। আস্তে আস্তে প্রেমটা গভীর থেকে আরও গভীর হয়। এই প্রেমটাই প্রথম আলোর সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নে রূপ নেয়। কিন্তু প্রথম আলোর সাংবাদিক হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! তবে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে। ২০১০ সালের ১ এপ্রিল আমি যুক্ত হই প্রথম আলোতে।

প্রথম আলো কি শুধুই পত্রিকা? অনেকের কাছে দৃশ্যত তাই-ই মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে প্রথম আলো পত্রিকার বাইরে অনেক কিছুই। প্রথম আলো মানুষের কল্যাণকর অনেক কাজের সঙ্গেই জড়িত। পাশাপাশি পত্রিকাটি কর্মিবান্ধবও। তাই তো প্রথম আলো আমার কাছে মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর।

আমার বিচার-বিশ্লেষণে এই পত্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ‘বদলে যাও, বদলে দাও’। এই স্লোগানই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, মনের জোর বাড়িয়েছে শত-সহস্র গুণ। এ ধরনের জীবনমুখী স্লোগানের জন্যই মনের ভেতর সব সময় ইতিবাচক চিন্তা মাথায় আসে, নেতিবাচক কিছু ভাবতেই পারি না।

‘ভালোর সাথে আলোর পথে’—এই স্লোগান এই পত্রিকাকে মানুষের কাছে জননন্দিত করেছে, ঠাঁই নিয়েছে মানুষের মণিকোঠায়। এসব স্লোগানের জন্যই এই পত্রিকা মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে পারিবারিক পত্রিকা। ‘সত্যে তথ্যে ২৪’—এবারের এই স্লোগানও বেশ চমৎকার ও যুগোপযোগী। ‘যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো’। এসব পাঠকনন্দিত স্লোগানের জন্য পত্রিকাটি মানুষের মানসপটে চিরজাগরূক থাকবে।

প্রথম আলো কতটা সর্বজনস্বীকৃত ও পাঠকনন্দিত, তার একটি গল্প বলি। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের এক দুপুরে আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি, সেটির লিফটম্যান এক বাসচালকের সহকারীকে মারধর করেছেন। লিফটম্যান ঘটনাস্থল থেকে পালানোর সময় পথচারীরা তাঁকে ধরে পুলিশে দেন। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িওয়ালা আমার বাসায় এসে হাজির।

বলতে থাকেন, ‘সাংবাদিক ভাই, দ্রুত রমনা থানায় ফোন দেন, লিফটম্যান লিটন মিয়াকে ছাড়িয়ে আনেন। এই নেন এসআইয়ের (উপপরিদর্শক) নম্বর।’ আমি তাঁকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করি, ‘আমি ডেস্কে কাজ করি, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’ কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, বারবার বলতে থাকেন, আমি ফোন দিলেই কাজ হবে। তাঁর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হই ফোন দিতে।

নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই অপর প্রান্ত থেকে ওই এসআই বলেন, ‘দেখেন ভাই, প্রথম আলোর সাংবাদিক কখনো রিকোয়েস্ট করেন না। আপনি যখন বলেছেন, তাহলে মামলা নেব না।’ ফোন রেখেই ভাবলাম, প্রথম আলোর এত গ্রহণযোগ্যতা! আর আমি সেই পত্রিকার সাংবাদিক। সেদিন থেকেই আমি এই পত্রিকার সাংবাদিক নই, একজন ফেরিওয়ালা ও অ্যাম্বাসেডর (দূত) হিসেবে কাজ করছি।

২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক এক কাজে সিরাজগঞ্জে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার র‍্যাবের তৎকালীন প্রধান কর্মকর্তা লে. কর্নেল আনিসুজ্জামান আমার কাছ থেকে কাজের বিষয়টি জেনে সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গাইল র‌্যাবকে ফোন করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় খবর পাই, আমার কাজ হয়ে গেছে। ওই দিন আমার উপলব্ধি হয়, প্রথম আলো আমার সামাজিক অবস্থানটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে।

প্রথম আলো নিয়ে আরও কিছু সুখকর অভিজ্ঞতা আছে। সেসব সুখস্মৃতি আজও অম্লান, মধুর। পত্রিকাটি শুধু আমার কাছে নয়, অধিকাংশ মানুষের কাছেই পারিবারিক এক বন্ধনের নাম।

লেখক: প্রথম আলো পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক ও বিশাল বাংলা বিভাগের উপবিভাগীয় প্রধান