দুর্নীতি উন্নয়নের বড় বাধা

ইফতেখারুজ্জামান

একাত্তরে ১৩৪ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে ২০২২ সালের মধ্যে ২ হাজার ৮২৪ ডলার গড় মাথাপিছু আয়ের দেশে পৌছানো বাংলাদেশের জন্য যেমন গৌরবময় তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০৩১–এ মধ্যম ও ২০৪১–এ উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে; একই সঙ্গে ২০৩১–এর মধ্যে চরম দারিদ্র্যহীন এবং ২০৪১–এর মধ্যে সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হবে।

বাংলাদেশের এ অর্জন ও সামনের লক্ষ্য কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাধারণ জনগণের জন্য অর্থবহ, এ বিষয়ে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হলে। বাংলাদেশের জাতীয় আয় দুই দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ৫-৭ শতাংশ হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যসহ নির্ভরযোগ্য গবেষণা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ যদি মোটামুটি মধ্যম মাত্রায় কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে এ হার আরও ২-৩ শতাংশ বেশি হতো।

অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত জাতীয় খানা জরিপ ২০২১ অনুযায়ী, শুধু সেবা খাতে ঘুষ বা ‘পেটি করাপশন’–এর শিকার হয়ে সেবাগ্রহীতাদের যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তার প্রাক্কলিত পরিমাণ বার্ষিক জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। 

দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ পাচারের সার্বিক পরিমাণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ হারে অর্থ পাচারকারী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২০০৮-১৫ মেয়াদে পাচার হওয়া অর্থের বার্ষিক গড় পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ২৭৫ বিলিয়ন ডলার। হালনাগাদ সম্ভব হলে এ প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের বার্ষিক পরিমাণ বছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়। 

এ ছাড়া হুন্ডিসহ আরও বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়, যার গন্তব্য হিসেবে মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’, কানাডার ‘বেগমপাড়া’সহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ—এমনকি তথাকথিত অফশোর দ্বীপের বিনিয়োগ ও আবাসন খাতের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। সম্প্রতি পুলিশের সিআইডি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী আয় খাতে মোবাইল আর্থিক লেনদেনে জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ থেকে বছরে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে।

দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রের এই বিশাল সামষ্টিক ক্ষতির পাশাপাশি এর বৈষম্যমূলক প্রভাব আরও গভীরতর উদ্বেগজনক, যা উন্নয়নের সুফল থেকে সাধারণ জনগণকে বঞ্চিত করছে। দুর্নীতি দারিদ্র্য, অবিচার, বৈষম্য ও প্রান্তিকীকরণ বাড়ায়। যখন উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি অবারিত বিচারহীনতা উপভোগ করে, তখন নিম্নপর্যায়ের ‘চুনোপুঁটি’র দুর্নীতি ব্যাপক ও গভীর হয়। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নাগরিক অধিকার–সংশ্লিষ্ট খাতসহ সার্বিকভাবে সেবা খাতে অবৈধ লেনদেন অপরিহার্য হয়ে সেবাগ্রহীতাকে জিম্মিদশায় আবদ্ধ করে।

দুর্নীতির শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে পেশাগত পরিচয়ের কারণে খুব একটা ছাড় পাওয়া যায় না। বরং লক্ষণীয় যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ৫১ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রেও দুর্নীতির বৈষম্যমূলক প্রভাব রয়েছে। যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরপ্রাপ্ত, তাঁদের ক্ষেত্রে এ হার ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

দুর্নীতির ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় হয়, ধনিক ও প্রভাবশালীবান্ধব ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতিচর্চার বিকাশ হয়, আইনের শাসন ব্যাহত হয়, রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমে দুর্বলতর হয় এবং শাসনব্যবস্থার ওপর জন–আস্থার সংকট ত্বরান্বিত হয়। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতানির্ভর গবেষণায় আরও দেখা যায়, দুর্নীতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিকাশ ও সুরক্ষায় অন্যতম প্রতিবন্ধক। তদুপরি দুর্নীতির সুরক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে তথ্য প্রকাশ ও বাক্​স্বাধীনতা এবং সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করাকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী যে ৩৩১ জন মানবাধিকারকর্মীকে নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে, তার ৯৮ শতাংশ এমন সব দেশে, যেখানে দুর্নীতির মাত্রা প্রকট। 

বাংলাদেশেও দুর্নীতির অবিচার ও বৈষম্যমূলক আর্থসামাজিক প্রভাবের ফলে জবাবদিহিমূলক সুশাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রত্যাশা ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। সুশাসনের প্রায় সব আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একদিকে হতাশাজনক, অন্যদিকে যেসব দেশে সাম্প্রতিক কালে আয়বৈষম্য ও অতিধনী বাড়ার হার সর্বোচ্চ মাত্রায়, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্যারিসভিত্তিক বৈশ্বিক অসমতা ল্যাবের তথ্যমতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশের মালিক ছিলেন ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তি আর ১৬ শতাংশ ছিল মাত্র ১ শতাংশ অতিধনীদের করায়ত্ত। 

দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল বা পথরেখা নেই। অন্যদিকে রাজনৈতিক, সরকারি, ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্জিত প্রভাবশালী অবস্থানকে ক্ষমতার অপব্যবহার, তথা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রয়োগে পেশাগত উৎকর্ষ ও সৎ সাহসের ঘাটতি এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থান সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল নির্ধারক হওয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে চুনোপুঁটি নিয়ে টানাহেঁচড়া হলেও রুই–কাতলার বিচারহীনতা স্বাভাবিকতা লাভ করেছে। এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া ন্যায়বিচারভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অভীষ্ট অর্জন সম্ভব, এরূপ প্রত্যাশার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই।

লেখক: টিআইবির নির্বাহী পরিচালক