দীর্ঘায়িত নিম্নচাপ কাটবে কীভাবে

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বৈদেশিক লেনদেনে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ধারাবাহিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিভিন্ন খাতে দেওয়া ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলার। ইউক্রেন আক্রমণের ছয় মাস আগেই রিজার্ভের ক্ষয় শুরু। ঋণপত্রের নিষ্পত্তি ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে ব্যাংকগুলো অস্বস্তিতে। এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে। পণ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। 

গত অর্থবছরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়। আগের বছরের থেকে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার বেশি। ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির গড় ১০ শতাংশের বেশি হয়নি। আমদানিতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালে ৫৭ শতাংশ ব্যয় হলেও শিল্পোৎপাদন ও রপ্তানি আয়ের সঙ্গে মিলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যেও পার্থক্য লক্ষণীয়। নজিরবিহীন কারণ হিসেবে আলোচিত ওভার–ইনভয়েসিং বা আন্ডার–ইনভয়েসিংসহ গরমিলের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান হচ্ছে না। দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসায় অন্তর্ভুক্তির এবং কানাডার বেগমপাড়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে অর্থের জোগান বাংলাদেশ থেকেই হতে হয়। রেমিট্যান্স দিয়ে বাণিজ্যের ঘাটতি ও পুঁজি পাচার পুষিয়ে নেওয়া হতো। রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভে টান পড়ছে। 

সরকারের আয়-ব্যয়ের নগদানেও টান পড়েছে। মূল্যস্ফীতিতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্য সংযোজন কর বাড়লেও শুল্ক ও আয়করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। জাতীয় আয়ের দেখানো প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতিহীন। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর করের ভার বাড়লেও উচ্চবিত্তদের কর পরিহার ও ফাঁকি খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে! ফলে ঋণ বেড়ে চলছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। অন্যদিকে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। এভাবে চললে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে। দিন শেষে জনগণকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। 

করোনায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্রের আয়রোজগার-সঞ্চয় তলানিতে নেমেছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় নতুন দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ছে। চরম অদক্ষতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে চলছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। সঠিক তালিকার অভাবে করোনাকালে নগদ সহায়তার জন্য ৫০ লাখ লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হলেও ৩৫ লাখ গৃহস্থালিকে দেওয়া গেছে। টাকার বিনিময়ে টিসিবির পরিবার কার্ড দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জনসংখ্যা সোয়া ৫ শতাংশের বেশি বাড়লেও খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশের কম। আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। চাহিদামাফিক আমদানি করতে না পারলে বিপদ বাড়বে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করতে পারছে না। এতে পুষ্টিহীনতা বাড়ছে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমেছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কৃষকের অর্থায়ন দরকার। গ্রাহক হিসেবে কৃষক সেরা হলেও কৃষিঋণের হার ১০ শতাংশের অনেক নিচে। 

দূরদৃষ্টির অভাব জ্বালানি নিরাপত্তাকে চাপে ফেলেছে। উৎপাদন স্থাপনা করা হলেও মৌলিক জ্বালানির জন্য আমদানিনির্ভরতা, গ্যাস উত্তোলন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সঞ্চালনব্যবস্থায় যথাযথ বিনিয়োগ না হওয়ায় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিভাগ দ্রুত সমাধানের পথ দেখছে না। গ্যাস সরবরাহে চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকায় রপ্তানি শিল্পসহ কারখানার উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বাড়ায় উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। উদ্যোক্তাদের দাবি, পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কমছে। এক খাতকেন্দ্রিক নির্ভরতা ও বহুমুখীকরণহীনতা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। 

করোনার আগেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে স্থবির। বিনিয়োগ স্থবিরতায় করোনার আগেও কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি চলছিল। প্রবৃদ্ধির অন্যতম অংশ সরকারি ব্যয় থেকে এলেও বর্তমানে নিম্নমুখী। 

কার্যকরী প্রতিষ্ঠানের অভাব দৃশ্যমান। অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ না বাড়ার ঘোষণা দিলেও নানা ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও সাড়ে তিন বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ‘লুটপাটে’ জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ ডেপুটি গভর্নরের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। আর্থিক খাত প্রতিটি কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করে। 

বর্তমানে অর্থনীতি দীর্ঘায়িত নিম্নচাপে পড়েছে। দীর্ঘায়িত নিম্নচাপ মোকাবিলা ও উত্তরণে কথামালা ও আত্মতৃপ্তি থেকে বেরিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব স্বীকার করে নিম্নচাপগুলোর কেন্দ্রবিন্দু নির্ধারণ ও কার্যকর বাস্তবায়নযোগ্য নীতিকৌশল প্রণয়ন প্রয়োজন। সংকেত যেতে হবে, অর্থনৈতিক দীর্ঘায়িত নিম্নচাপ মোকাবিলায় সরকার দরকারি পদক্ষেপ নিচ্ছে। 

জনগণের হাতে নগদ অর্থের প্রয়োজন পড়বে; রাষ্ট্রের দরকার হবে অনেক বেশি নগদ অর্থের। আমদানি ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দরকার। আইএমএফের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ ঝুঁকি নিরসনে যথেষ্ট নয়। পুঁজি পাচারবিষয়ক কার্যকর তদন্ত হলে ও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে পারলে সাশ্রয় হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আয়কর থেকে আদায় এক নম্বরে নিতে হবে। বর্তমানের ব্যবস্থা বাদ দিয়ে পারফরম্যান্সভিত্তিক প্রণোদনায় তথা কর্মসংস্থান সৃজন করলে অথবা রপ্তানি আয় দেশে এলেই প্রণোদনার অর্থছাড় নীতিতে যেতে হবে। 

জীবনযাত্রার সংকট উত্তরণে ছড়ানো নিরাপত্তাজাল কর্মসূচিগুলো একক ও সমন্বিত প্রশাসনিক ছাতার আওতায় আনতে হবে। কর্মসূচিগুলোর সম্মিলিত বিশাল অর্থ সঠিক গৃহস্থালিতে যাওয়ার জন্য জাতীয় জনসংখ্যা তথ্যভান্ডার গড়ে তোলাকে জাতীয় আবশ্যিক ঘোষণা করে সার্থকতার সঙ্গে এনআইডি যাঁরা করেছেন, তাঁদের নিয়োজিত করা যায়। এসব বিবেচনায় রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কোনো ধরনের ভুল পদক্ষেপ পরিহার সময়ের দাবি। অন্যথায় সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। 

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক