বই পড়ানোর আয়োজনে ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ

প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা প্রকাশ করছি দেশে–বিদেশে থাকা আমাদের পাঠকের লেখা। তাঁরা লিখেছেন তাঁদের নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্য অভিজ্ঞতার     গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা।লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার নিজের এলাকা দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা, সংস্কৃতি বা অবকাঠামো—সব দিক থেকেই পিছিয়ে। গোষ্ঠীগত হানাহানি আর রাজনৈতিক সহিংসতার দাপটে কোনো সামাজিক সংগঠনই গড়ে উঠতে পারেনি এখানে। ভালো মানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো নেই–ই, জেলা শহর মাগুরা অনেক দূরে থাকায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইও হাতের নাগালে পাওয়া যায় না।

এসব নিয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু নানা কিছু ভাবছিলাম। ২০১৮ সালের এক শীতের রাতে মধুমতী নদীর পাশে বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এলাকায় একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলব। আমরা শুধু গতানুগতিক সাহিত্য আসরই করব না, এই অঞ্চলের কিশোরদের হাতে ওদের পড়ার উপযোগী বইও তুলে দেব। আমাদের এলাকাটা নবগঙ্গা আর মধুমতী নদীর মাঝখানে। নদী দুটোর নামের প্রথম অংশ নিয়ে সংগঠনের নাম রাখলাম ‘নবমতি সাহিত্য পরিষদ’।

কিছুদিন যেতেই উপলব্ধি করলাম, নিজেদের সাধ্যের চেয়েও ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে ফেলেছি। নিজেরা মাঝেমধ্যে বসে সাহিত্যসভা করেই ফেলা যায়। কিন্তু কিশোরদের হাতে বই তুলে দেওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের নিজেদের কাছেও দিয়ে দেওয়ার মতো অত বই তো নেই। তারপরও প্রত্যেকে কিছু করে দিয়ে বিতরণ করার মতো বইয়ের একটা পর্যায়ে পৌঁছানো গেল। এখন বইগুলো আমরা তাদের হাতে পৌঁছাব কীভাবে?

একটা সমস্যা পার হলে আরেকটা সমস্যা আমাদের ঘিরে ধরে। তবু পিছিয়ে গেলে তো আর চলে না। আমরা ঠিক করলাম, স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের হাতে বই তুলে দেব।

স্কুলটাইমে গিয়ে ওদের একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষতি করা ঠিক হবে না। আমরা বেছে নিলাম ছুটির দিন। বই নিয়ে যেদিন স্কুলে যাব, আগেই তার খবর ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো।

এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা বইয়ের গুরুত্ব বোঝে না। বই পড়ায় ওদের তেমন আগ্রহও দেখিনি। তাই আমি আশা করেছিলাম, ১০-১৫ জন ছেলেমেয়ে এলেই যথেষ্ট। প্রথম দিন নির্ধারিত স্কুলে পৌঁছে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। ৫০-৬০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী এসে হাজির হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, বয়স্ক অনেক মানুষও আমাদের কার্যক্রম দেখার জন্য হাজির হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরাও আমাদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে আগ্রহী। বুকটা একেবারে ভরে গেল।

আমাদের বইয়ের সংকট তো ছিলই। যা প্রস্তুতি ছিল, তাতে সবাইকে বই দিয়ে কুলিয়ে ওঠা গেল না। অনেকেই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন। আমরা সবাইকে বলে দিলাম, নিজেদের পড়া শেষ হলে তাঁরা যেন প্রতিবেশী বন্ধুকেও বইটি পড়তে দেন। তাতে সবাই বই পড়ার সুযোগ পাবেন।

এভাবে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কার্যক্রম চলতে লাগল। বই যাতে ঠিকমতো ফেরত পাওয়া যায়, সে জন্য একটা নিয়ম চালু করা হলো। বই পড়ে কেউ ফেরত দিলে তাকে একটি কলম উপহার দেওয়া হবে। এবার আগের চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী বই পড়তে লাগল। আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হলেন, বই দিয়ে সহায়তা করলেন।

করোনার সময় যখন পুরো পৃথিবী থমকে গেল; তা যাক, আমাদের এই কর্মসূচি তখন যেন নতুন করে আরও বেগবান হয়ে উঠল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তখন বন্ধ। এ কারণে পুরো সময়টা আমরা এ কাজে দিতে পেরেছিলাম।

আমাদের কার্যক্রম এখনো চলছে। ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা যখন বই হাতে করে হাসিমুখে ঘরমুখো হয়, ওদের দেখে তখন মনটা ভরে যায়।