রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
একের ভেতর দুই সাকিব আল হাসান
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
ভিক্টোরিয়া আর অগ্রণী ব্যাংকের খেলা। আমাদের দল ভিক্টোরিয়া। সে দলে সাবেক ক্রিকেটার আজম ইকবালও ছিলেন। আমরা সে ম্যাচে সাকিব আল হাসানকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সেটিই ছিল তার প্রথম ম্যাচ।
প্রিমিয়ার লিগ বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় খেলা। এ পর্যায়ে পৌঁছাতে বছরভর কষ্ট করে হাজার হাজার খেলোয়াড়। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগে ওই বয়সী একটা ক্রিকেটারের মানসিক চাপে ভোগাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ খেলোয়াড়কেই আমরা এ রকম পরিস্থিতিতে নার্ভাস হতে দেখে এসেছি।
কিন্তু আমি আর আজম ভাই দেখলাম, পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে সাকিব, গুনগুন করে গান গাইছে। আজম ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী রে ভাই, ওর কোনো ভয়ডর নেই? ম্যাচের আগে বসে বসে গান গাইছে!’
কিছুক্ষণ পর সে ব্যাটিং করতে গেল, ৩৯ রানের মতো করল। বোলিংয়েও মনে হয় ২ উইকেট নিল। খেলা শেষে আজম ভাই আমাকে বললেন, ‘এই ছেলেটা অন্য রকম। ওকে দেখে রাখিস।’ মনে আছে, আজম ইকবালই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সাকিব যে একটু আলাদা, তা ধরতে পেরেছিলেন।
সাকিবকে আমি তার আগেই দেখেছিলাম, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। সাকিবের মধ্যে বিশেষ কিছু ছিল বলেই তাকে তৃতীয় বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার লিগে নিয়ে আসা হয়। আমি জানতাম, ওর ভেতর কী আছে। এরপর সাকিবের ধীরে ধীরে বড় ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা তো সবারই জানা। তবে তার ক্যারিয়ারের দীর্ঘ যাত্রার কথা বলতে গেলে আমার ভিক্টোরিয়া-অগ্রণী ব্যাংকের ম্যাচের ওই স্মৃতিটা মনে পড়ে।
শুরুতে সাতে বা ছয়ে ব্যাটিং করত সাকিব। পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হিসেবে ওকে বিবেচনা করতাম না। ওই সময় আসলে আমরা সাকিবকে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই দেখতাম। ডেভ (হোয়াটমোর) আর আমি তার বোলিংটাকেই বেশি কাজে লাগাতে চাইতাম। ডেভ তখন এ ধরনের ক্রিকেটারই খুঁজছিলেন। সাকিবের মনে আছে কি না জানি না, তবে আমার মনে আছে, তাকে বলেছিলাম, ‘তুই যখন ব্যাটিংয়ে নামবি, চেষ্টা করবি যেন নটআউট থাকা যায়।’ দেখা গেছে, সাকিবের প্রথম ১৫-২০ ম্যাচে ব্যাটিং গড় ছিল ৭০-৮০–এর মতো। আপনি যখন দেখবেন যে ২০ ম্যাচ পর আপনার গড় ৭০-৮০, তখন মানসিকভাবে আপনি নিজেকে ব্যাটসম্যান ভাবতে শুরু করবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিজের মধ্যে ব্যাটসম্যানসুলভ আত্মবিশ্বাস চলে আসবে।
তবে বোলিং বরাবরই সাকিবের শক্তি। জেমি সিডন্সেরও এ ক্ষেত্রে অনেক অবদান আছে। তাকে ঘোষণা দিয়ে বোলার হিসেবে খেলিয়েছেন জেমি। সেই ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেট নিয়েছে। সাকিবকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমি ওই সময়ের কোচদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান দেখি। তাঁরাই সাকিবকে ভালো করার মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন। প্রথম দিকের ওই সাফল্য তাকে আত্মবিশ্বাসীও করে তোলে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও ওই সময়টা ছিল অন্য রকম। নতুন এসে সাফল্য পাওয়া ক্রিকেটার খুব বেশি ছিল না। সাকিব ব্যতিক্রম ছিল। আর তাকে ব্যতিক্রমী করেছে তার মানসিকতা।
আমাদের ক্রিকেটে কিছু ছেলে আসে, যারা প্রথম প্রথম সাফল্য পেয়েই অনেক মাতামাতি করে, যেন দুনিয়ার সবকিছুই তার কাছে চলে এসেছে। আবার ভালো করতে না পারলে মনে হয় সব শেষ। অনেকে তো একেবারেই ভেঙে পড়ে। সাকিব সে রকম কখনোই ছিল না। সে ওই কঠিন কাজটাই বছরের পর বছর করে এসেছে। ফল যেমনই হোক, একই রকম থাকার চেষ্টা করেছে এবং সেটা ছোটবেলা থেকেই। বরাবরই সে খুব ভারসাম্যপূর্ণ মানসিকতার। যত সময় গেছে, যত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তার এই গুণ আরও শাণিত হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের ক্রিকেটারদের জন্য এটা দারুণ দক্ষতা।
হ্যাঁ, এ–ও ঠিক, দিন শেষে সাকিব একজন মানুষ। সে–ও ভুল করেছে, অনেক ভুলই করেছে। তবে অন্যদের সঙ্গে তার যে পার্থক্যটা দেখি, সেটা হলো ভুল থেকে দ্রুত শেখা আর একই ভুল বারবার না করা। এই যেমন ক্যারিয়ারের শুরুতে সংবাদমাধ্যম সামলানোর ক্ষেত্রে কিছু ভুল করেছে। কিছু কথা বলে ফেলেছে, যা বলা তাঁর উচিত ছিল না। ক্যারিয়ারের শুরুর আরও কিছু ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা অল্প বয়সের ভুল হিসেবে ধরাই যায়। সময়ের সঙ্গে সাকিব ভুল থেকে শিখেছে, আরও পরিণত হয়েছে।
তখনকার আরেকটা গল্প বলি। কোনো একটা ঝামেলায় পড়ার পর সাকিবকে নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। ওই সময় কোনো এক দিন সাকিবের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাইরের এত আলোচনা তাকে যেন স্পর্শই করেনি। অথচ আমি তাকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কথাবার্তার একপর্যায়ে সে আমাকে বলল, ‘আপনি এত পত্রিকা পড়েন কেন? না পড়লেই তো পারেন। চাপ যদি না-ই নিতে পারেন, তাহলে পড়েন কেন?’ তখন বুঝলাম নিজেকে কীভাবে চাপ থেকে দূরে রাখতে হয়, সাকিব সেটা ভালোই জানে।
পারফরম্যান্সের কারণে কখনো সে চাপে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। সাকিব যেহেতু অলরাউন্ডার, একটা সুবিধা সে শুরু থেকেই পেয়েছে। ব্যাটিং নইলে বোলিং, কোনো না কোনোভাবে সে কিছু করেই দেয়। কোনো না কোনোভাবে ম্যাচে সরাসরি ভূমিকা রাখে। কয়েক ইনিংসে হয়তো রান পাচ্ছে না। ওই সময়টা সে বোলিং ভালো করবে। ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা তখন আর খুব একটা চোখে পড়বে না। আমি বলব, বোলিংটা থাকায় সেই অর্থে পারফরম্যান্সের চাপ তাকে স্পর্শ করেনি। এটা বরং তাকে সাহসী খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। সে জানে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে সে দলকে সাহায্য করবেই। আর ফিল্ডিংয়ে তো সে বরাবরই দুর্দান্ত।
সাকিবের আরেকটা ভালো গুণ, সে খুব দ্রুত শিখতে পারে। পরিকল্পনার জায়গায় খুব নিখুঁত। সামনে কোন খেলাটা আছে, কোন কাজটা করবে, এই পরিকল্পনা অনেক আগেই গোছানো থাকে। তার চিন্তার জগৎ অনেক গভীর।
২০১৯ সালে আইসিসির নিষেধাজ্ঞা তার ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা হয়ে আসে। সাকিবকে ভালোভাবে বুঝতে চাইলে ওই সময়েও একটু ফিরে যেতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই তখন আমাদের সবার মন খুব খারাপ। কিন্তু আমরা যতটা বিধ্বস্ত ছিলাম, সাকিব ততটা ছিল না। অন্তত বাইরে থেকে দেখে তা-ই মনে হয়েছে। যদিও সে কাছের মানুষদের নিজের মনের অবস্থা বুঝতে দিত না। তার মাথায় বা মনে কী চলছে, তখনো তা বুঝতে দেয়নি। হয়তো ভেতরে-ভেতরে সে–ও অনেক বিধ্বস্ত ছিল কিন্তু আমরা সেটা ধরতে পারতাম না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যে তাকে নিয়ে চিন্তা করছি, সাকিব সেটা ধরে ফেলত। দেখা যাচ্ছে উল্টো সে আমাদেরই সান্ত্বনা দিচ্ছে!
নিষেধাজ্ঞার সময়টায় সাকিবের জন্য মানসিক প্রস্তুতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগেও সে লম্বা বিরতি কাটিয়ে খেলায় ফিরেছে। এর আগে অন্য এক ঘটনায় বিসিবিও তাকে একবার ছয় মাস নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ফিরে এসে ঠিকই ভালো করেছে। তখনো মাঠে নামার তাগিদ, মানসিক প্রস্তুতি, সবকিছুই চলছিল সরলরেখার মতো। খেলার মধ্যে না থাকলেও সাকিবের মস্তিষ্ক চলতে থাকে। কল্পনায় নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। এ কারণে ফেরার পর শুরু থেকেই পারফর্ম করতে ওর সমস্যা হয় না।
এমন একজন ‘টু ইন ওয়ান’ ক্রিকেটারকে যেকোনো অধিনায়কই দলে চাইবে। কারণ, সাকিব থাকা মানে কার্যত দুজন ক্রিকেটার দলে থাকা। সাকিব দলের বাইরে থাকলে দল সব সময়ই তার শূন্যতা অনুভব করে। ফেরার পর তাকে আবার আলিঙ্গন করে নেয়।
একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে দলের ভাবনাটা যখন এ রকম থাকে, যখন তার জন্য দলের দরজা সব সময়ই উন্মুক্ত থাকে বলে সে জানে, তখন ওই ক্রিকেটারও মানসিকভাবে খুব ভালো অবস্থায় থাকে। দলে নিজের গুরুত্বটা সে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। সাকিবের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম দেখিনি কখনো। তার অগ্রাধিকার তালিকায়ও দলের ভালোটাই সবার আগে দেখেছি সব সময়।
মোহাম্মদ সালাউদ্দিন: সাকিব আল হাসানের মেন্টর; জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ