রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সমান বয়সী
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমান বয়সী’—এ রকম একটা কথা তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক-পরিচিতিতে লেখা হতো। কথাটার একটা সময়গত সত্যতা আছে। মুক্তিযুদ্ধের সমসময়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছিল। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ আমরা সাধারণভাবে একাত্তরের পর থেকে শুরু করি না; বরং সাতচল্লিশে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার পর থেকে পূর্ব বাংলা অঞ্চলে যে সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে, তার নিরিখেই ধারণাটা গড়ে উঠেছে। তবু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতায় বড় ধরনের বদল ঘটেছিল, আর তার সাপেক্ষে সাহিত্য-শিল্পও বড় ধরনের বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে গেছে।
সেদিক থেকে হুমায়ূন কিংবা তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ‘বাংলাদেশের সমান বয়সী’ বলে সাব্যস্ত করা যেতে পারে। তবে হুমায়ূনের ক্ষেত্রে অভিধাটার অন্য গুরুতর তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তত মধ্যবিত্ত পরিসরে নতুন আবির্ভূত বাস্তবতার সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সুরত অঙ্কিত হয়েছে হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মে। আর সেদিক থেকে বাংলাদেশের মূলধারার জনগোষ্ঠীর পরিচয় যেমন তাঁর সৃষ্টিকর্মে তুলনামূলক ভালোভাবে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি কোনো সন্দেহ নেই অন্তত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোলোকের গড়নেও এর বড় প্রভাব ও ভূমিকা আছে।
হুমায়ূন আহমেদ যে আশির দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী অন্তত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের এবং এক অর্থে সংস্কৃতি জগতের সবচেয়ে দৃশ্যমান বাস্তবতা ছিলেন, তার সঙ্গে বোধ হয় সময়ের একটা আনুকূল্য যুক্ত ছিল। সময়টা ছিল করপোরেট অর্থনীতি বিকাশের আগের জমানা; ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগ, গণমাধ্যম ও বিনোদন বিকশিত হওয়ার আগের পর্ব। আধা নাগরিক, আধা মফস্সলীয় একটা আবহে পারিবারিক জীবন ছিল মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের প্রধান পরিচয়। এর মধ্যেই বই, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সিনেমাকে কেন্দ্র করে যে বিনোদন-কারখানা গড়ে উঠেছিল, সেখানে নিজেকে প্রায় একচ্ছত্র সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হুমায়ূন। বাজারের আবহ ও গড়ন তাঁর সৃষ্টিকর্মকে প্রভাবিত করেছিল, আর তিনিও কার্যকরভাবে অংশ নিয়েছিলেন তার নির্মাণে। একুশের বইমেলায় দশকের পর দশক হুমায়ূন যেভাবে নিজের কেন্দ্রত্ব বজায় রেখেছিলেন, তা আসলে বিনোদনধর্মী উপাদানের উৎপাদনে তাঁর অমিত সাফল্যের প্রকাশ।
বাংলাদেশে বিনোদন-কারখানার বিচার-বিশ্লেষণ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাঠামোগত নির্মাণে তার ভূমিকা নির্ণয়ের কোনো চর্চা বিকশিত হয়নি। ফলে এ বাবদ হুমায়ূন তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। জনমানুষের মুখে মুখে এবং বিনোদন-সাংবাদিকতায় যথেষ্ট পরিমাণে স্বীকৃত হলেও একাডেমিক ঘরানার বিশ্লেষণ না হওয়ায় তার গুণগত মান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে, তাঁর সময়ের সাহিত্য-কারবারিরা জনপ্রিয়তা ও সাহিত্যকে বিপরীত বর্গ হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে হুমায়ূনের সাহিত্যকর্মও জুতসই বিচার-বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গির সচেতন বা অচেতন প্রতাপের এক প্রমাণ, সত্তরের দশকে তিনি যে কটি উপন্যাস লিখেছিলেন, সেগুলো সাহিত্যের মূলধারার উৎপাদন হিসেবেই নির্ণীত হয়েছে; এবং অদ্যাবধি এ মত সমাজে ব্যাপকভাবে চালু আছে যে প্রথম দুই উপন্যাসই—নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি (হুমায়ূন আহমেদ: পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য, প্রথমা, ২০২০ দ্রষ্টব্য), এ বিবেচনা হুমায়ূন আহমেদের বিপুল কৃতিত্বকে লঘু করে দেখায় তো বটেই, এমনকি কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তাঁকে উপস্থাপন করে না।
ছোটগল্প রচনায় হুমায়ূনের স্বভাবসুলভ সিদ্ধি ছিল। জীবনের ছোট ছোট অনুভূতি ও উপলব্ধিকে প্রগাঢ় মহিমা দেওয়া তাঁর শিল্পীসত্তার প্রধান শক্তি। তদুপরি পরিমিত সাংকেতিক ভাষায় পরিস্থিতি ও চরিত্রের ভিতর-বাহিরকে বাঙময় করতে পারা তাঁর অনন্য কুশলতা। দুটোই ছোটগল্পের নান্দনিক স্বভাবের অন্তর্গত। এ স্বভাবে ভর করে তিনি লিখেছেন ‘রূপা’, ‘বুড়ি’, ‘পিঁপড়া’, ‘খেলা’, ‘শিকার’, ‘খাদক’, ‘চোখ’, ‘একজন ক্রীতদাস’, ‘অপরাহ্ণ’, ‘জ্বীন-কফিল’, ‘অয়োময়’, ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’, ‘শীত’, ‘পাপ’, ‘সৌরভ’, ‘গুণীন’, ‘লিপি’ ইত্যাদি চমৎকার ছোটগল্প। অন্যদিকে বড় পটভূমির উপন্যাস রচনায় সাফল্য তুলনামূলক কম হলেও একক প্লটের ছোট উপন্যাস বা নভেলায় তাঁর কৃতিত্ব প্রশ্নাতীত। এই বসন্তে, অচিনপুর, ১৯৭১, আগুনের পরশমণি, আমার আছে জল, গৌরীপুর জংশন, জনম জনম, দ্বৈরথ, নন্দিত নরকে, নবনী, নি, প্রিয়তমেষু, ফেরা, মধ্যাহ্ন (প্রথম খণ্ড), যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, শঙ্খনীল কারাগার, শূন্য ইত্যাদি উপন্যাস জীবনের বিচিত্র নিরীক্ষা এবং রূপকল্পের সুমিত সংস্থানে অনন্য। এ দুই বর্গে ছোটগল্প ও নভেলা—হুমায়ূন কেবল বাংলাদেশের নয়, বাংলা সাহিত্যেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
তবে ‘বাংলাদেশের সমান বয়সী’ শিল্পী হিসেবে হুমায়ূনের কৃতিত্ব আসলে এই সফল রচনার তালিকা থেকে ঠিকঠাক বোঝা যাবে না। বোঝার জন্য তাঁর গণতান্ত্রিক মেজাজ আর ইতিবাচক জীবনদৃষ্টির অভীপ্সার দিকে নজর ফেরাতে হবে। তুলনামূলক পশ্চাৎপদ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় উপনিবেশিত মনস্তত্ত্ব ও অনুকরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল প্রতাপ। এ মনোভঙ্গি জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন ও বাস্তবতাকে সাদাচোখে দেখা এবং উপস্থাপন করার কাজটিকে খুব জটিল করে তোলে।
নিশ্চয়ই আমাদের বহু সাহিত্যিক-শিল্পী এদিক থেকে নিজ নিজ কেতায় লড়াই করেছেন এবং সাফল্যও পেয়েছেন। কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হয়, শিল্পী-স্বভাবের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ বাবদ হুমায়ূনের সাফল্য অনেক বেশি। এ কারণেই সত্তর ও আশির দশকের বাংলাদেশের সমাজ ও সামগ্রিক সংস্কৃতির পরিচয় বোধকরি অন্য যেকোনো শিল্পীর তুলনায় হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মেই সবচেয়ে নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাতে কাঠামোগত পরিচয় হয়তো তুলনামূলক কম, ভাবাদর্শিক নিরীক্ষা হয়তো তাঁর সচেতন প্রয়াসের অঙ্গীভূত হয়নি, কিন্তু আরোপণ-মুক্ত যাপিত জীবনের যে সম্ভার হুমায়ূন উপস্থাপন করেছেন, তার সম্ভবত কোনো দোসর নেই।
বলেছি, সচেতনভাবে তিনি ভাবাদর্শিক নিরীক্ষাকে প্রাধান্য দেননি। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উৎপাদনগুলোর মধ্যে তাঁর সৃষ্টিকর্মেই সম্ভবত এককভাবে সবচেয়ে বড় ভাবাদর্শিক নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। পশ্চিম ও কলকাতানির্ভর, আধুনিক, সেক্যুলার, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, মৌলবাদবিরোধী—এসব বর্গের ছত্রচ্ছায়ায় যদি বাংলাদেশের শিক্ষিত-নাগরিক সমাজের মূলধারার চর্চাকে চিহ্নিত করি, তাহলে বলতে হবে, এসব বর্গের প্রতি হুমায়ূনের বিশেষ কোনো বিরাগ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতের প্রতীকী উপস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন রূপে গভীর-তাৎপর্যবহ লিপ্ততা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর সাহিত্যিক-শৈল্পিক উৎপাদনের জন্য এর চেয়ে বড় সত্য হলো, তিনি ওই ‘মূলধারার চর্চা’কে নিষ্ক্রিয়ভাবে অনুমোদনও করেননি। ওই ধারা স্বভাবতই সংকীর্ণ, আরোপণমূলক এবং জনবিরোধী। হুমায়ূনের গণতান্ত্রিক এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তা মোটেই যথেষ্ট ছিল না। কাজেই তাঁর উপস্থাপনায় এমন উপাদানের প্রাধান্য আছে, যা ওই সংকীর্ণতায় আঁটে না; এবং জীবনদৃষ্টির অবিচল ব্যক্তিত্ব আছে, যা আধিপত্যশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে অনবরত প্রশ্নবিদ্ধ করে। সরল করে বলা যায়, বাংলাদেশে বিবদমান দুই চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যবর্তী এক পরিসর নির্মিত হয়েছে হুমায়ূনের সামগ্রিক চর্চায়, যেখানে মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের সর্বোত্তম সুরত যেমন মূর্ত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যও সবচেয়ে ইতিবাচক প্রস্তাব আছে।
হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্মের অন্যতম প্রধান সত্য এই যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একাত্তরে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার ভৌগোলিক, জনমিতিগত এবং ভাবগত সত্যই একাধারে তাঁর অনুকরণের এলাকা এবং আবিষ্কারের প্রণোদনা। সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন, পোশাক, খাবার, অবসর ও বিনোদন তাঁর লেখায় প্রায়ই আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে; বর্ষা ও জোছনার মতো উপাদানগুলোকে তিনি মধ্যবিত্তের সক্ষমতার মধ্যেই উপভোগ্য করে তোলেন; নাগরিক পরিসরে সর্বশ্রেণির সমন্বিত বাস্তবের ভাঁজে ভাঁজেই চারিয়ে দেন হিমুর ইচ্ছাপূরণের গল্প আবার এর মধ্যেই ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’-এর পাটাতনে নেন রাষ্ট্রতন্ত্রের নিগূঢ় সমালোচনার সুযোগ; বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামো আর প্রকৃতি ব্যবহার করে জমিয়ে তোলেন মিসির আলির তুখোড় রহস্যময়তা; আর নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমন্বয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকেও নিজের শৈল্পিক আয়োজনের আওতায় আনেন। ভাটি অঞ্চলের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উৎপাদনকে কথাসাহিত্যে-সিনেমায়-টিভি প্রোগ্রামে অনবরত পুনরুৎপাদন করতে থাকেন শিক্ষিত-নাগরিক অভিজ্ঞতার সেই পরিসরে, যাকে তিনি নিজের পরিসর হিসেবে আবিষ্কার করেছেন। এসব উপস্থাপনায় ‘অপরায়ণ’জনিত সংকট থেকেও নিজেকে তিনি যথাসম্ভব হেফাজত করতে পারেন—তাঁর গণতান্ত্রিক ও সমন্বয়ধর্মী মেজাজের কারণেই। মোটেই বিস্ময়কর নয়, নাগরিক মধ্যবিত্তের মতো গ্রামজীবনের, এমনকি গ্রামীণ নিঃস্ব-শ্রেণির উপস্থাপনায়ও হুমায়ূন প্রায় অতুলনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। এ সবই তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাংলাদেশ-লিপ্ততার প্রকাশ।
বিপুল সাহিত্যকর্ম ও গদ্যরচনা, টিভি, সিনেমা, মিডিয়া ও পাবলিক স্পেসে উপস্থিতি, গালগল্প ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া ইত্যাদি মিলে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রূপকার হিসেবেই বন্দিত হবেন।
মোহাম্মদ আজম: হুমায়ূন–বিষয়ক বইয়ের লেখক; অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়