১৮৫০ সালে যুক্তরাজ্যে পাস হয় পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট। যদিও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অভিজাত ও রক্ষণশীল সদস্যরা সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা তৈরির জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ ব্যয়ের বিপক্ষে ছিলেন। তবু তাঁদের বিরোধিতার মুখেও শেষ পর্যন্ত আইনটি পাস হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যে লাইব্রেরি আইন প্রণয়ন, কয়েকজন রাজকর্মচারীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং এ অঞ্চলে ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির চেষ্টায় ১৮৫৪ সালে বাংলা অঞ্চলে একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঁচটি গণগ্রন্থাগার। স্থানগুলো হলো যশোর, বগুড়া, রংপুর, বরিশাল ও হুগলি।
এই প্রথম পাঁচটি গ্রন্থাগারের মধ্যেও আবার সক্রিয়তার দিক থেকে যশোরের লাইব্রেরিটি অনন্য, যার পুরো নাম যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি। কারও কারও মতে, সালটা হবে ১৮৫১। যশোরের তৎকালীন জেলা কালেক্টর আর সি রেকস এই লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। মনে রাখতে হবে, তখনো হয়নি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি স্কটল্যান্ডও তখন গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার অধিকার পায়নি। আর যশোর তখন এক মফস্সল শহর, লোকসংখ্যা ৮ হাজারের সামান্য বেশি।
তবে প্রথম ৫০ থেকে ৬০ বছর এটি পুরোদস্তুর গণগ্রন্থাগার ছিল না। ছিল ইংরেজ শাসক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবসর বিনোদনকেন্দ্র, আড্ডাস্থল। একদিকে লেখাপড়ার ব্যবস্থা, অন্যদিকে আড্ডাঘর, বিলিয়ার্ড টেবিল। গ্রন্থাগারকে ঘিরেই ১৯০৯ সালে নির্মিত হয় টাউন হল, ১৯১৯ সালে নিউ আর্য থিয়েটার আর ১৯২১ সালে বি সরকার মেমোরিয়াল হল। একদিকে বইপাঠ ও সাহিত্যসভা, অন্যদিকে গানের আসর, নাটকের অভিনয়, খেলার মাঠে সরগরম নানা প্রতিযোগিতা—সব মিলে এই লাইব্রেরির প্রভাবে যশোর হয়ে ওঠে ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক রাজধানী।
গণগ্রন্থাগারটির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে যশোর ইনস্টিটিউটে ঘাঁটি গাড়ে ব্রিটিশ বিমানবাহিনী। সেই দুর্দিনে এগিয়ে আসেন সাধারণ মানুষ আর যশোর পৌরসভা। পৌরসভার হলরুমে স্থানান্তরিত হয় সব বই। যুদ্ধ শেষে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায় গ্রন্থাগার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ও এটি শাসকদের রোষানলে পড়ে, লাইব্রেরিতে তালা ঝোলায় পুলিশ, পোড়ায় অনেক মূল্যবান বই। পুলিশি হামলার মুখে গ্রন্থাগারসংশ্লিষ্ট অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হন।
গ্রন্থাগারটির আধুনিকায়ন হয় গত শতকের ষাটের দশকে। খোলা তাক প্রবর্তন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বইয়ের শ্রেণিবিন্যাস শুরু হয় তখন থেকেই। এ কাজে দুজনের নাম স্মরণীয়—রওশন আলী ও শরীফ হোসেন। তাঁদের নেতৃত্বে একটি কর্মীবাহিনী প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ পাঠাগারে পরিণত করে।
লাইব্রেরিতে একদিন
১৮ অক্টোবর বিকেল চারটা। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা চত্বরের পাশেই যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির দুটি ভবন। একটি দোতলা, অপরটি তিনতলা। তিনতলা ভবনটির নাম আঞ্চলিক কেন্দ্রীয় বই ব্যাংক ভবন। উত্তরমুখী ভবনটির প্রধান ফটক পার হতেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির পূর্ব পাশে লম্বা একটা কক্ষ। নাম অধ্যাপক মোহাম্মদ ইয়াকুব উন্মুক্ত পাঠকক্ষ। জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে পড়েছে কক্ষজুড়ে। দেয়াল ঘেঁষে চারপাশে তাকগুলো বইয়ে ঠাসা। জনা বিশেক লোক সংবাদপত্র পড়ছেন। এখানে ৩৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং দুটি সাময়িকী রাখা হয়।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে রেফারেন্স বিভাগ। এখানকার বেশির ভাগ বই একাডেমিক। সেখানে পড়ছিলেন ৪০ জন পাঠক। তাঁদের মধ্যে ১০ জন নারী। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি খুঁজছেন আসমা সুলতানা। বললেন, ‘দেড় বছর ধরে ছুটির দিন বাদে সব দিন বেলা সাড়ে তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত এখানে পড়ি।’
তিনতলায় উঠে বাঁ পাশে একটি বড় কক্ষ। এটা পাণ্ডুলিপি, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, সংরক্ষণ এবং সংগ্রহশালা বিভাগ। এখানে হাতে লেখা প্রায় ২০০ পাণ্ডুলিপি আছে। কিছু তুলট কাগজ ও তালের পাতায় লেখা। বেশির ভাগের ভাষাই সংস্কৃত। ডান পাশে অধ্যাপক শরীফ হোসেন গবেষণাগার। এটা মূলত গবেষকদের জন্য।
সরকারি ছুটি বাদে গ্রন্থাগারটি গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা এবং শীতকালে বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে মোট তালিকাভুক্ত বইয়ের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৫২২। ৪২ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করছেন আবু জাহিদ। কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘প্রতিদিন লাইব্রেরিতে গড়ে ১৫০ জন পাঠক পড়তে আসেন। এর মধ্যে পত্রপত্রিকা পাঠকের সংখ্যাই বেশি, মূলত তাঁরা চাকরিপ্রার্থী। বই পড়তে আসা পাঠক কম। অথচ আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ জন বই পড়তে আসতেন।’
যশোরের বিদ্বজ্জন হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলেন, গ্রন্থাগারটির যাবতীয় খোলনলচের আধুনিকায়ন জরুরি। এ জন্য দরকার বড় বিনিয়োগ। তাই ১৭০ বছরের প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করছে, তার ছোঁয়া যশোর ইনস্টিটিউটের গায়েও লাগুক।
লেখক: প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক এবং যশোর প্রতিনিধি