শুভেচ্ছাবার্তা

দেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের গুণীজনদের সমর্থন, সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা সব সময় পেয়ে এসেছে প্রথম আলোপ্রথম আলোর উদ্বোধনী সংখ্যা এবং পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত তাঁদের কয়েকজনের শুভেচ্ছাবার্তা এখানে সংক্ষেপে পরিবেশন করা হলো।

‘প্রথম আলো’র জয় হোক

শামসুর রাহমান

আরও একটি দৈনিক পত্রিকার জন্ম হলো আমাদের দেশে। ফলে সম্প্রসারণ ঘটল সংবাদপত্রের জগতে। নতুন পত্রিকাটির নাম রাখা হয়েছে প্রথম আলো। আলো শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় আরেকটি শব্দের কথা। এই শব্দটি অন্ধকার। আলো প্রস্ফুটিত হওয়া মাত্রই আমরা জানি, অন্ধকার পরাজিত সৈনিকের মতো পালিয়ে যায়। বাংলাদেশে আরও কিছু দেশের মতোই নানা ক্ষেত্রে বিপুল অন্ধকার রয়েছে। প্রথম আলো কি পারবে সেই অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে! আমরা পশ্চাত্পদতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, অনাচার ইত্যাদি অন্ধকারের স্বৈরাচার থেকে মুক্তি পেতে পারব কি? প্রথম আলো কি এই নাছোড় অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হবে? ভরসার কথা, এই লড়াইয়ে প্রথম আলো নিঃসঙ্গ নয়।

 প্রথম আলোর হাল যাঁরা ধরেছেন, আমি সম্পাদক মতিউর রহমান এবং প্রকাশক মাহ্ফুজ আনামের কথা বলছি, তাঁদের যোগ্যতা এবং সাফল্য ইতিমধ্যে সবার প্রশংসা অর্জন করেছে।...তাঁরা দুজনই প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযোদ্ধা, অন্যায়, অবিচার, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, শঠতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সর্বদা আপসহীন। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম আলো প্রথম আলোর মতোই নির্মল, উজ্জ্বল খবরের কাগজ হয়ে উঠবে জন্মলগ্ন থেকেই।...

আমি প্রথম আলোর সার্বিক উন্নতি ও গৌরবময় স্থায়িত্ব কামনা করি। জয় হোক এই নবজাতকের, অব্যাহত থাক এর অগ্রযাত্রা।

 ৪ নভেম্বর ১৯৯৮

প্রথম আলো নিয়ে দুকথা

সন্​জীদা খাতুন

পৃথিবীর ওপরে সূর্যের প্রথম কিরণ-সম্পাত অর্থাৎ প্রথম আলো সম্পর্কে আমাদের বেশ একটু কোমল রঙিন অনুভূতি আছে। রবীন্দ্রনাথ তো এই প্রথম আলো নিয়ে আমরণ শিহরিত হয়ে থেকেছেন, সেই ১২ বছর বয়সের উপনয়ন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে।...

 আমরা তো জানি রবীন্দ্রনাথ, নামের ঐক্যের দরুনও হতে পারে, সূর্যের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করেছেন সব সময়। শুধু নিজের নয়, সমগ্র মানবসমাজের সঙ্গেই সূর্যের নিবিড় যোগের কথা বলে এসেছেন। সেকালে প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্ব–সংক্রান্ত ধারণাসূত্রেই সূর্যের সন্তান ভেবেছেন মানুষকে।

পরিণত বয়সে নিজের ঈশ্বরকে খুঁজতে গিয়ে আলোকের প্রকাশকে ‘সৃষ্টির প্রথম রহস্য’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বালককাল থেকে আলোর মন্ত্রই তাঁর কাছে ‘পৃথিবীর জন্মদিনের আদি মন্ত্র’ (পনেরো, পত্রপুট)। তাই শাস্ত্র-মিলিয়ে-বাছা ফুল তুলে পূজা করতে যাননি তিনি, তাঁর দেবতার জন্য ছিল ‘সকল দেশের সকল ফুল,/ এক সূর্যের আলোকে চিরস্বীকৃত’। অনুভব করেছিলেন সূর্যের মতন মানুষও যদি আপন অন্তরের আলো ছড়িয়ে দেয় জগতের ওপরে, সকল মানুষের অভিমুখে, সেই আলোতে এক হয়ে মিলতে পারে সবার সঙ্গে তবেই জীবনের সার্থকতা। এই মিলনে উচ্ছলিত হবে ‘ভালোবাসার অমৃত’, যা কবির কাছে ‘সৃষ্টির শেষ রহস্য’। এই আলো আর প্রেমেই জগৎকে আর মানুষকেই ঈশ্বরের মতো জেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পূজা নেমে এসেছিল ‘দেবলোক থেকে মানবলোকে।’

৪ নভেম্বর ১৯৯৮

আমার কাগজ প্রথম আলো

ফারুক চৌধুরী

প্রথম আলোর অনন্যতার জায়গা একটি নয়, অনেক। পত্রিকাটি নিজেকে শুধু সংবাদ প্রকাশের বাহন করে তোলেনি, বরং সমাজের সব ভালোকে সংগ্রথিত করে এটি আমাদের সর্বদাই নবনির্মাণের উপাখ্যান শুনিয়েছে। এই দেশ ও সমাজের অগ্রগতি ও কল্যাণই তার অন্বিষ্ট, এ নিয়ে তার ভাবনা ও প্রয়াসের যেন কোনো অন্ত নেই। দেশের বাইরে, প্রবাসে যে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর বসবাস, তাদেরও প্রথম আলোই যেন এক অভিন্ন ঐক্যসূত্রে গেঁথে রেখেছে। 

যখন বিদেশে যাই, তখনো অগ্রসর তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে স্বদেশ আমার সঙ্গেই থাকে। এর মূলেও আছে প্রথম আলো। বস্তুত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালি পাঠকদের প্রতিদিনই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একই সুতোয় গেঁথে রাখে প্রথম আলো। বিভুঁই বিদেশে প্রতিটি বাংলাদেশির জন্যই যেন তার কল্যাণচিন্তা, এক অভূতপূর্ব ব্যাকুলতা। আবার দেশের যে তরুণ প্রজন্ম, তাদের স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্বও পালন করে চলেছে প্রথম আলো। এর সবকিছুই আমি উত্সুক দৃষ্টি নিয়ে অবলোকন করি, একটি পত্রিকার জন্মক্ষণ থেকে তার ক্রমবিকাশের এই বর্ণাঢ্য ইতিহাস আমাকে অভিভূত করে।

একজন ক্রীড়ামোদী পাঠক হিসেবেও প্রথম আলো পড়ে আমি অসাধারণ আনন্দ পাই। ফুটবল আর ক্রিকেট ম্যাচের বিবরণ, অলিম্পিকের আখ্যান বর্ণনা—সবই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।… নেহাতই মুদ্রিত অক্ষর—কিন্তু কী আশ্চর্য ক্ষমতায়, তা চেতনার জগতে আলোড়ন তোলে।

২৫ নভেম্বর ২০১২

হওয়া চাই হৃদয়বান এবং নিষ্ঠুর

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রথম আলো সব সময়েই নির্মল, প্রসন্ন ও হৃদয়বান; কিন্তু আবার নিষ্ঠুরও। প্রত্যাখ্যান করে সে অন্ধকারকে। প্রত্যাখ্যান নয় কেবল, অন্ধকারকে সে তো বিদীর্ণই করবে। নইলে আলো কেন? প্রতিদিন নতুন করে তার আবির্ভাব। প্রতিদিন সে বলে, এই দিনটি ভালো যাবে আগের দিনের চেয়ে। হায়, আগের দিন, সে কি খারাপ ছিল? যেন তা–ই হয়, আগের দিনকে যেন খারাপ মনে হয় নতুন দিনের তুলনায়। সেটাই প্রত্যাশা।...

দেশে ভালো কাজ যে হচ্ছে না, তা নয়। সৃষ্টিশীলতা আছে। উদ্যম রয়েছে। অর্জনও যে নেই, তা নয়। কিন্তু সেসব খবর কাগজে আসে কম। আলোকে উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে না, যার ফলে উত্ফুল্ল হচ্ছে অন্ধকার। ওদিকে জনগণ আজ যে কতটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ, তার খবরও কেউ রাখে না। ...অথচ ওই ক্রোধকে সৃষ্টিশীল ধারায় প্রবাহিত করা সম্ভব। সম্ভব তাকে সমাজবদলের শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। তার জন্য
জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ আবশ্যক। সংবাদপত্র ওই শক্তি হবে না নিশ্চয়ই, কিন্তু ওই শক্তিকে সাহায্য করতে পারে। ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত আছে।

এসবই প্রত্যাশার কথা। প্রথম আলো এ প্রত্যাশা পূরণ করবে কি? কে জানে। যদি করে, তবে বলা যাবে, হ্যাঁ, সে নতুন বটে। বলা যাবে সে হৃদয়বান এবং হৃদয়বান বলেই নিষ্ঠুর। অন্ধকারকে সে চেনে। শত্রু হিসেবে। অনুত্পাদক খাতে কর্মব্যস্ত ইঁদুরদের একটি নয়, জনগণের পক্ষাবলম্বনকারীদের একজন। 

৪ নভেম্বর ১৯৯৮

আলো, আমার আলো

এবিএম মূসা

ক্রমারোহণ করতে গিয়ে প্রথম আলো শুধু সংবাদ ও মন্তব্য প্রতিবেদনে বৈচিত্র্য আনেনি, সম্পাদক ও নিত্যনতুন ধারণার উদ্ভাবক মতিউর রহমান সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার একটি দায়বদ্ধতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। এই দায়বদ্ধতা হচ্ছে সামাজিক দায়িত্ববোধ, পত্রিকাটি রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যেমন পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে, একইভাবে সমাজ বদলানোর দায়ভার নিয়েছে, যা আলোচিত, সমালোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যান্য পত্রিকা থেকে এখানেই প্রথম আলোর ভিন্নতা।…

প্রথম আলো অ্যাসিডদগ্ধদের একটি অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকার পাতায় এখন অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর অনেক কম দেখা যায়। এই মানবতাসংশ্লিষ্ট ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি কি আর্থিক অথবা পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছে? এমনই আরেকটি ব্রত নিয়ে প্রথম আলো আমাদের বিপথগামী যুবাদের সামাজিক-পারিবারিক জীবনে ফিরিয়ে আনছে। তা হলো মাদককে ‘না’ বলুন।…

প্রথম আলো আমাদের গণমাধ্যম-জগতে যে এমনই অনেক সামাজিক সচেতনতার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে যাচ্ছে, নিছক সংবাদ বিতরণ করে না। নোটবই পড়া ছাত্র এখন গণিত শেখার চর্চা করছে। কিশোর-কিশোরী বিদেশে যাচ্ছে প্রথম আলোর প্রচারে নয়, বাংলার খুদে প্রতিভাধরদের বিশ্বদরবারে পরিচিত করতে যোগ দিচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াডে। চলমান বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছেলেমেয়েদের সাধারণ জ্ঞানের ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রথম আলো এসবই করছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা পরিস্ফুট করতে।

৪ নভেম্বর ২০১৩