৭০ ভাগই জোগান দিচ্ছে চট্টগ্রাম

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম রং বা পেইন্টিং কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে এলিট পেইন্টের হাত ধরে। এক বছর পরই পেইন্টিং ইন্ডাস্ট্রিতে যাত্রা শুরু করে রক্সি পেইন্টস। এরপর একে একে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পেইন্টিং কোম্পানি। এর মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে বার্জার এবং এশিয়ান পেইন্টস। ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান পেইন্টস সারা বিশ্বে দশম অবস্থানে এবং এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এর বাইরে আরও রয়েছে পেইলাক পেইন্ট, মুন স্টার, আল করিম পেইন্টস, উজালা পেইন্টস। ব্যাপক নগরায়ণ এবং ব্যবস্থাযোগ্য আয়ের ফলে বাংলাদেশে রংশিল্পের বিকাশ ঘটেছে খুবই দ্রুত।

মানুষের জীবনযাত্রার মান যত উন্নত হচ্ছে, তত বাড়ছে রঙের চাহিদা। দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে রঙের বাজার। স্বপ্নের বাড়ি বা কর্মক্ষেত্রকে রাঙিয়ে তুলছে মানুষ। সরকারি–বেসরকারি অফিস–আদালতসহ বিভিন্ন স্থাপনাকে দৃষ্টিনন্দন করতে ব্যবহার হচ্ছে রং। রং উৎপাদনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের এই রঙের চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগই জোগান দিচ্ছে বন্দরনগর চট্টগ্রাম। কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে রংশিল্পে এখনো মাথা উঁচু করে আছে চট্টগ্রামের কারখানাগুলো।

দেশীয় উদ্যোক্তারা জানান, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে চাহিদামতো এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না তাঁরা। চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন, যে কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে তাঁরা লোকসানের দিকে ঝুঁকিতে। এভাবে চলতে থাকলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দেশীয় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য তাঁরা সরকারি সহযোগিতা দাবি করেছেন।

 রঙের বাজারে মূলত দখল রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। এসব কোম্পানি ৯০ ভাগ বাজারের অংশীদার। বাকি ১০ শতাংশ দেশীয় কোম্পানির দখলে রয়েছে। অর্ধেকের বেশি মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে আছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে এশিয়ান পেইন্টস। এ ছাড়া বাজারে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ডসের একজোনোবেল, জাপানের নিপ্পন এবং নরওয়ের জয়তুন পেইন্টস। দেশের বাজারে গ্রাহক ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনছে।

এই শিল্প বিকাশে চট্টগ্রামের সোনালি অতীত রয়েছে। বার্জার পেইন্টস প্রথম চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কারখানা চালু করে। পরে ঢাকায়ও করা হয়। এলিট পেইন্টসের পরে চট্টগ্রামে বিশেষ করে স্বাধীনতার পর অলিম্পিক পেইন্ট (আগে ইস্টার্ন কেমিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড), বাক্সলী পেইন্টস, আল হোসাইন পেইন্টস, আল করিম পেইন্টস, রনি কেমিক্যালস, মনিলাক পেইন্টস, মৌসুমি পেইন্টস, নাফি পেইন্টস, আইডিয়াল পেইন্টস যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে রনি কেমিক্যালস, মৌসুমি পেইন্টস, নাফি পেইন্টস, আইডিয়াল পেইন্টসহ কয়েকটির কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

আইডিয়াল পেইন্টসের মালিক গাজী শফিউল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতাসহ নানা কারণে তারা কারখানা বন্ধ করে দেন। নগরের বহদ্দারহাটের খতিবের হাট এলাকায় মুন স্টার পেইন্টসের কারখানা। এটির চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বড় ভাইয়ের হাত ধরে আল হোসাইন পেইন্টসের মাধ্যমে এই শিল্পে তাঁর পথচলা শুরু। পরে তাঁর এক বন্ধু বদরুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে মুন স্টার চালু করেন। ১৯৮৪ সালের দিকে যাত্রা শুরুতে এই শিল্পে তাঁদের বার্ষিক বিক্রি হতো ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। আর ওই সময় তাঁদের পণ্য ছিল মাত্র ১০টি। ৩৯ বছর পর বর্তমানে তাদের পণ্যের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৮০ কোটি টাকা। আবদুল হান্নান আরও বলেন, প্রয়োজনমতো কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় উৎপাদন কম হচ্ছে। বিক্রিও কম। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন তাঁরা। এটি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন শীর্ষ এই ব্যবসায়ী।

পুরোনো রংশিল্পের মধ্যে চট্টগ্রামের আরেকটি হলো অলিম্পিক পেইন্টস। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদ্যুৎ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার আগে ইস্টার্ন কেমিক্যাল ওয়ার্কস নামের তাদের প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত ছিল। পরে এটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭৮ সালে অলিম্পিক পেইন্টস যাত্রা শুরু করে। দেশের রঙের বাজারের ৭০ ভাগই চট্টগ্রাম জোগান দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রদ্যুত মজুমদার বলেন, এই শিল্প বরাবরই অবহেলার শিকার। করোনার ধস কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি করতে পারছেন না শিল্প মালিকেরা। চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ কাঁচামাল তাঁরা আমদানি করতে পারছেন। দ্রুত এটি সমাধানের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি এই শিল্পকে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনারও দাবি জানান তিনি। দেশীয় এই শিল্প টিকে না থাকলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে অন্যান্য পণ্যের মতো। এতে খরচ আরও বেশি পড়বে। এ জন্য এখনই দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।