পঁচিশের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার: অমর্ত্য সেন

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ খুব ভালো

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে প্রথম আলোপ্রথম আলোর জন্য তাঁরা লিখেছেন বিশেষ শীর্ষ রচনা, দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেসবের নির্বাচিত একটি অংশ রইল এখানে।

অমর্ত্য সেন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি পাশাপাশি জনকল্যাণের জন্য মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা—এগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেদিক থেকে আমাদের এ অঞ্চলে অগ্রগতিও আছে, সমস্যাও আছে। বাংলাদেশ বলেন, ভারত বলেন, রাষ্ট্রকে এই দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। দেখা যায় যে আমাদের রাজনীতিবিদ বা সরকার, তাঁরা যে কথাগুলো বলেন, সেগুলো রক্ষা করেন না। এই যে একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের ভাবনা বা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা—এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা জানতে চাইছি।

অমর্ত্য সেন: আমার মনে হয় বিভিন্ন স্বাধীনতার যে অঙ্গাঙ্গি যোগ, সেই দিক থেকে এই সমস্যাটার বিচার করতে হবে। যদি সরকারের কাছে দাবি করা হলো যে কিছু করা হোক—ভারতে হোক, পাকিস্তানে হোক বা বাংলাদেশে হোক, তারা সে দাবি শুনে যদি বলেন আমরা কিছু করব এবং তারপর তারা যদি না করেন, তাহলে এটা নিয়ে আলোচনা করা যে তাঁরা বলেছিলেন করবেন কিন্তু তাঁরা করলেন না। তাতে যে গাফিলতির একটা প্রমাণ পাওয়া গেল, সেটা নিয়েও তো সামাজিক আলোচনা চলতে পারে। সে জন্য সমালোচনা করার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত। খেতে না পেলে খাওয়া দেওয়া হবে, চিকিত্সার জন্য ব্যবস্থা করা হবে। তাঁরা বললেন, কিন্তু করলেন না। সেই স্বাধীনতাটাকে রূপ দিতে হলে আমাদের কথা বলা, প্রতিবাদ করা, আলোচনা করা, সংবাদ প্রকাশ করার স্বাধীনতাটা খুবই দরকার।

প্রশ্ন:

 প্রথম আলো: তাহলে আপনি বলছেন, গণতন্ত্র সরাসরি উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত?

 অমর্ত্য সেন: আমি তা-ই মনে করি। আমার বইতে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় লোকে প্রশ্ন করেন, গণতন্ত্রের ফলে উন্নয়ন হবে কি হবে না। প্রথমেই মানতে হবে, গণতন্ত্র উন্নয়নের একটা অংশ। যেমন ডিম সেদ্ধ করতে হলে জল ফোটানো দরকার। এই না যে ফোটানো জলটা আমরা খাব। কিন্তু তাই দিয়ে ডিমটা সেদ্ধ হবে। কিন্তু গণতন্ত্র জিনিসটা তো ঠিক গরম জলের ব্যাপার না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের একটা অংশ। যাঁরা খুব ধনী হলেন কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা নেই; তাঁরা যদি তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন, তাঁদের জেলে দেওয়া হয়, সেই দেশ উন্নত দেশ—এ রকম কথা বলতে পারা যায় না।

প্রথম কথা হচ্ছে, উন্নয়নের একটা অংশ হচ্ছে গণতন্ত্র। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, অন্যান্য আমাদের যে স্বাধীনতা-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা—সেগুলো গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দিয়ে আমরা জোর গলায় চাইতে থাকব এবং এ ক্ষেত্রে মৌনতা বোধ হয় অবিচারের এক প্রধান সহায়ক। মৌনতা দিয়ে মানবিক অধিকার পাওয়া যায় না।

মানবিক অধিকার পেতে হলে আমাদের জোর গলায় বলতে হবে, দাবি করতে হবে। সে জন্য গণতন্ত্রের ভূমিকা শুধু নিজের মূল্যের জন্য নয়। নিজের মূল্য তো আছেই। তার ওপরে যে স্বাধীনতার মূল্য আমরা দিই সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিত্সা ইত্যাদি ক্ষেত্রে, সেগুলোকেও সাহায্য করবে। এদের সঙ্গে যোগাযোগগুলো ইতিবাচক, নেতিবাচক নয় বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আবার তো গণতন্ত্রে সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বলেন, ভারতে বলেন, গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের ত্রুটিমুক্ত একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 

অমর্ত্য সেন: এটা ঠিকই। অনেক সময় লোকে গণতন্ত্রের ভুলটা চট করে চোখে দেখেন। কিন্তু তাঁরা যদি সময় নিয়ে দেখেন বা আমাদের গণতন্ত্রের ব্যবহারের যে সুযোগ, সে সুযোগ আমরা নিতে উদ্​গ্রীব থাকি, তার ফলে যে সামাজিক উন্নতি হতে পারে, সেটা অনেক সময় তাঁরা দেখেন না। আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি—ভারতের সঙ্গে যদি চীনের তুলনা করেন, চীনে গণতন্ত্র নেই, ভারতের আছে। অথচ দেখা যায় চীন অনেক বেশি উন্নতি করেছে। এটা একদিকে ঠিক। গোড়ার দিকে যখন চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল, তখন মাওয়ের নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, পরে সে তুলনায় কিছু হয়নি। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াও পিং যে সংস্কারটা করলেন, সেটা হলো চীনের জীবনপ্রত্যাশা বা গড় আয়ু তখন ভারতের চেয়ে ১৪ বছর বেশি। অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে চীনের অর্থনৈতিক প্রগতি অনেক বেশি দ্রুত হয়েছে। ভারতবর্ষেও মোটামুটি দ্রুত। তবে চীন এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজকে যদি দেখেন চীনের সঙ্গে ভারতের গড় আয়ু ১৪ বছরের জায়গায় কমে হয়েছে ৭ বছর এবং ভারতবর্ষের কিছু কিছু অংশ আছে, যেমন কেরালা, যেখানে গড় আয়ু চীনের থেকে চার-পাঁচ বছর বেশি। চীনে যেখানে ৭১, সেখানে কেরালায় ৭৫ বা ৭৬ এবং আমার ধারণা, কেরালার দিকে যদি দেখেন, কেরালার গুণটা হচ্ছে বহুদলীয় ব্যবস্থা, বিভিন্ন পার্টি দিয়ে তৈরি গণতন্ত্র আছে। তার ফলে কমিউনিস্ট পার্টিকে কংগ্রেস সমালোচনা করে। কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট পার্টি সমালোচনা করে। অন্যদিকে চীনের যে ধরনের রাজনৈতিক ভিশন বা দৃষ্টিভঙ্গি, তা থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল, কেরালায় সেটা গোড়া থেকেই ছিল। তার ফলে কেরালা চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার-পূর্ববর্তী সময়ের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তার সঙ্গে গণতন্ত্রকে মেলাতে পেরেছে। এটা একটা উদাহরণ। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কথা বলবেন? কী রকম দেখেন এ দেশের সম্ভাবনা? 

অমর্ত্য সেন: বাংলাদেশ তো আমার নিজের দেশ। আমি ছেলেবেলায় এখানে ছিলাম। কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করলাম। তারপর গেলাম শান্তিনিকেতনে। নানা সময়েই আমার মনে হয় ঢাকার কথা। মানিকগঞ্জে যে বাড়ি ছিল অথবা মামাবাড়ি বিক্রমপুরে অথবা বেড়াতে গেছি চট্টগ্রামে ইত্যাদি, এগুলো খুব মনে পড়ে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কী রকম দেখেন?

 অমর্ত্য সেন: আমার তো মনে হয় ভবিষ্যৎ খুব ভালো। যদি সামাজিক মাপকাঠিতে দেখেন, অনেক কথা, সামাজিক চিহ্নের কথা, যা এখন বলা হয়, তাতে তো বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে গেছে। শিক্ষার কোনো কোনো সূচকে এগিয়ে গেছে। আয়ুতে এখনো এগোয়নি। তা ছাড়া আমাদের যে এনজিও বলা যেতে পারে, বেসরকারি কাজের যে গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশে হয়েছে ব্র্যাক বা গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি, এগুলো পৃথিবীর কাছে বড় একটা জিনিস। আমার নিজের ধারণা, এটা শুধু দেখানোর জিনিস না, এতে সামাজিক একটা উন্নতি হচ্ছে এবং উন্নতির আরও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলোকে আরও কীভাবে পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া।

৩১ নভেম্বর ২০০৪