শিখোর প্রতিষ্ঠাতা শাহীর চৌধুরী (বাঁয়ে) ও জিশান জাকারিয়া

শাহীর চৌধুরী ও জিশান জাকারিয়া ছোটবেলার বন্ধু। ঢাকার সানবিমসে পড়তেন শাহীর আর আগা খানে জাকারিয়া। দুজন দুই স্কুলে ভর্তি হয়েও অটুট থেকে যায় সখ্য। ও লেভেলের পর দুজনেই চলে যান যুক্তরাজ্য। লন্ডনে স্নাতক করে বহুজাতিক ব্যাংক বার্কলেজে চাকরি নেন শাহীর চৌধুরী, সেখান থেকে এইচএসবিসি। আর জিশান স্নাতকোত্তর করে লন্ডনেই মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০১৮ সালে দেশে ফিরে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকায় (আইএসডি) যোগ দেন জিশান। আর শাহীর যুক্তরাজ্যেই থেকে যান। 

শিক্ষা নিয়ে দুজনেরই আগ্রহ। একসময় ভাবলেন, সহজে বেশি মানুষকে কীভাবে পড়াশোনায় সহায়তা করা যায়, তা নিয়ে কিছু করবেন। এই চিন্তার ফসল ‘শিখো’। ২০১৯ সালের এপ্রিলে যাত্রা শুরু করে এই অনলাইন শিক্ষা উদ্যোগ।

যেভাবে কাজ করে

জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী অনলাইনে সরাসরি ক্লাসের পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক নোট তৈরি করে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ করে দিয়ে থাকে শিখো। ফলে কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের বাসায় পড়তে যাওয়ার বদলে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই অনলাইনে পড়ালেখা করতে পারে। প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী এই স্টার্টআপ ব্যবহার করছে। 

বনানী ও গুলশান ২–এ শিখোর দুটি কার্যালয় রয়েছে। লাইভ ক্লাস এবং অন্যান্য কনটেন্ট তৈরির জন্য গুলশানের কার্যালয়ে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও। এ কার্যালয় থেকে সরাসরি ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকেরা বিভিন্ন ক্লাসের ভিডিও তৈরি করতে পারেন। অ্যানিমেটেড ভিডিওও এখানে তৈরি করা হয়। জটিল বিভিন্ন বিষয়কে অনলাইনে সহজ ভাষায় শেখানোর জন্য দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বা পাস করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একদল দক্ষ শিক্ষকও রয়েছেন শিখোডটকমে। 

৩৫ বছরের শাহীর চৌধুরী এখন শিখোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ৩৬ বছর বয়সী জিশান জাকারিয়া প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও)। প্রথমে যুক্তরাজ্য থেকে কাজ করলেও ২০২১ সালে শাহীরও দেশে চলে আসেন। বনানী ও গুলশানে শিখোর মোট কর্মী প্রায় চার শ। শিখোডটকমের প্রকৌশল দলের ৪২ সদস্যের সবাই ভার্চ্যুয়ালি প্রযুক্তিসেবা দিয়ে থাকেন। শুধু ঢাকায় বসেই নয়, সৈয়দপুর থেকেও একজন প্রকৌশলী ভার্চ্যুয়ালি কাজ করেছেন।

যাত্রা শুরুর তিন বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের এই অনলাইন শিক্ষা উদ্যোগ। বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস গত সেপ্টেম্বরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ১০০ স্টার্টআপ ও ছোট প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় ‘শিক্ষা ও নিয়োগ’ বিভাগে স্থান পেল শিখোডটকম। আন্তর্জাতিক এ স্বীকৃতি শিখোকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিত করে তুলেছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

শিখোডটকমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাহীর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অনেক বড়। আমরা আমাদের বড় লক্ষ্যের একদম শুরুতে রয়েছি। আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন কঠিন বিষয় আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা। এ জন্য আমরাই প্রথম অ্যানিমেটেড ভিডিওর মাধ্যমে দেশে শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি করা শুরু করি। এর মাধ্যমে আমরা জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির অধ্যায়ভিত্তিক বিষয়গুলো ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করছি। ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত দেখে বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে শেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের সহজে অনলাইনে পড়ালেখার সুযোগ দিতে ২০২০ সালে অ্যাপ চালু করি। এর মধ্যেই অ্যাপটি প্রায় ১৪ লাখবার ডাউনলোড করা হয়েছে। শিখোডটকমে বিনা মূল্যে বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক ক্লাস করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা চাইলেই ক্লাসগুলোতে অংশ নিয়ে মান যাচাই করতে পারে। পড়ালেখার মান ভালো মনে হলে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন কোর্সে নিবন্ধন করতে পারে তারা। আমাদের লাইভ ক্লাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ক্লাস শেষে শিক্ষকদের বক্তব্য বা ক্লাসনোট পাওয়া যায়। ফলে কারও সাহায্য ছাড়াই শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণভাবে বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখা করতে পারে। প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকায় মূল পরীক্ষার আগে নিজেদের পরখও করতে পারে। গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির বিকল্প না, সম্পূরক হিসেবে কাজ করছি আমরা।’

শুরুতে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্স পরিচালনা করলেও কিছুদিন আগে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির জন্যও কনটেন্ট যুক্ত করেছে শিখো। ছয় মাস আগে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন কোর্সও চালু করেছে। ভবিষ্যতে প্রকৌশল, মেডিকেলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোর্স চালুর পরিকল্পনা আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরও উন্নত মানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় শিখো। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলীরা কাজও শুরু করছেন। 

লেখক: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক