আফসানা বেগম

নারীর অধিকার মূলত মানুষেরই অধিকার, অর্থাৎ নারীরা মানুষ। সমাজে যে পুরুষতান্ত্রিক ধারণা প্রচলিত, তাতে সভ্যতার বহু পথ পেরিয়ে নারী এখনো পুরুষের সমান নন।

আইন নারীকে সম্পত্তি বণ্টনের সময়ে পুরুষের তুলনায় কম দেয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যে তিনি নির্যাতনের শিকার হন। পরিবার তাঁকে অল্প বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য করে। সমাজের নিয়ম রক্ষার্থে নিজের যৌনতা ও জননপ্রক্রিয়ার স্বাধীনতা তাঁর থাকে না। অন্যদিকে ৩০ শতাংশ নারী প্রত্যক্ষ যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। নারীর ওপরে সব রকম বলপ্রয়োগ আদিম ও আধুনিক অপরাধ, তবে এসবের প্রতি সমাজের বর্তমান সহনশীলতা কোনো অংশে কম অপরাধ নয়।

পরিস্থিতি নাজুক হলেও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হয় না। হাইকোর্টে পেশ করা পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল অবধি ৫ বছরে প্রায় ২৭ হাজার ধর্ষণ মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ব্যুরো অব জাস্টিসের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার ধর্ষণের শিকার হন। বাংলাদেশে অবশ্য এ রকম কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে জানা কথা, নারী সবখানে অরক্ষিত। কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়, গণপরিবহনে, বাড়িতে, বাজারে—কোথাও নিরাপদ নন।

নারীর বিবেচনাবোধের ওপরে রাষ্ট্রের আস্থা আসে আঠারো শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে, যখন প্রথম নিউজিল্যান্ডে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে নারী ভোট দিতে পারেন। বলতে গেলে, মাত্র উনিশ শতকে বিভিন্ন দেশে নারীকে মত প্রদানের উপযোগী বলে ভাবা হয়। মোটাদাগে রাষ্ট্র অশরীরী হলেও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার আধার। রাষ্ট্র নারীকে মতে, অর্থে ও অধিকারে পুরুষের নিচে অবস্থান করতে দেখলে স্বস্তি বোধ করে। রাষ্ট্র মূলত একটি পরিবারই—বহু পরিবারের সমষ্টি। রাষ্ট্রে যে আইন চলে, ক্ষুদ্র একটি পরিবারে সে আইনই চলে। রাষ্ট্র যদি অবদমনের সংস্কৃতি আপন করে নেয়, অবলীলায় তা চেপে বসে পরিবার ও ব্যক্তির ওপর। তার কাছে তখন নারীর ওপর ধর্ষণ-সন্ত্রাস পরিচালনা করা যতটা যৌন, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার দম্ভের বহিঃপ্রকাশ।

সামাজিক শিক্ষা বা দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে কোন অবস্থান দেয়? 

সিনেমায় নারীর ওড়না বা আঁচল টেনে ধরা যায়, কাটপিসে নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, কৌতুকের বেশির ভাগ হয় নারীর প্রতি অবমাননাকর। এভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা মেনে নিতে কৈশোরকাল থেকে মানুষকে প্রস্তুত করা হয়। 

কয়েক দিন আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক নারী ধর্ষণের পর ৩২ দিন বিচার চাননি বা বছরখানেক আগের ধর্ষণের কথাও প্রকাশ করেননি। আইনের প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি কতটুকু অনাস্থা থাকলে একজন অত্যাচারিত নারী চুপ থাকেন? পরিবারের সদস্যরাও নারীকে তাঁদের সম্পত্তি মনে করেন, নারী নিজের জন্য বিচার চাইবেন কি না, তা-ও পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন। সোজা কথায় ধর্ষণ নারীর একার শরীর ও মনের ওপরে ঘটলেও সমাজে শরীর-মনসমেত নারীর নিজস্ব কণ্ঠ বা অস্তিত্ব নেই।

সব প্রতিকূলতার মধ্যে নারী যদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চান, তখন বাল্যবিবাহ, অনিচ্ছাকৃত সন্তানধারণ, ক্ষেত্রবিশেষে কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা, এইডস বা পাচার তাঁর পথ রোধ করে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খল ও সামাজিক নিগ্রহ উপেক্ষা করে ওপরে উঠলেও শ্রমের মূল্যের জন্য পুরুষের সঙ্গে তাঁর লড়াই চলে। কারণ, একই শ্রমের জন্য পুরুষ নারীর তুলনায় বেশি পারিশ্রমিক পান। সাধারণ দ্রব্য উৎপাদন কারখানা থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র—সবখানে নারীকে শ্রমের মূল্যে ঠকিয়ে মুনাফার দিকে নজর দেওয়া হয়। 

দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষুদ্র থেকে জাতীয়, যেকোনো পরিসরে নারী বরাবর নিজের কৃতিত্বের প্রমাণ দিলেও বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীর উপস্থিতি মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০২০ সালে পৃথিবীময় আলোচিত ব্যবসার মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাশের কর্ণধার নারী। কেবল খেলার ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়েছেন, ২০২০ সালের বাতিল হওয়া অলিম্পিক গেমসে ৪৯ শতাংশ স্থানে নারীর অংশগ্রহণের কথা ছিল। বাংলাদেশে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতে ৬০ শতাংশ নারী কর্মী। বহুমাত্রিক সফলতা অর্জন করলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পুরুষের কর্তৃত্বের ঊর্ধ্বে উঠতে নারীর প্রচেষ্টা নিরন্তর।

নারীর ওপর যাঁদের কর্তৃত্ব থাকে, রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত হলে, তাঁদের মূল খুঁটি থাকে বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতায়। সে কারণে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তার পালিত বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন সংঘটিত হয় বেশি। ক্ষমতার অপব্যবহার বরাবরই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নারীর শরীরের দখল চায়। আর সে জন্য ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে ইয়াসমিন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী আনন্দ-উৎসবে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন পূর্ণিমা। আর আজও সেই একই কারণে সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় তনু ধর্ষণের শিকার হন, ক্ষমতার খুঁটির জোরে গুন্ডারা সিলেটের এমসি কলেজের মাঠ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে তরুণীকে। এসব ঘটনার পেছনে কারণ একটাই—অপরাধীর ক্ষমতার দৌরাত্ম্য, যা তাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতি আস্থাশীল করে।

ধর্ষণ ছাড়াও রাষ্ট্রে গুম, খুন, অর্থ পাচার ইত্যাদি অপরাধ একই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ঘটে থাকে। যে রাষ্ট্রে প্রকাশ্য খুনের বিচার হয় না, জনগণের টাকা অনায়াসে পাচার হয়, স্বল্পোন্নত দেশ হলেও ধনীর সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধির হার হয় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি, সেখানে আর সব অপরাধের বিচার থমকে থাকবে, কেবল নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচার হবে—এমনটি কি আশা করা যায়?

এই তো সেদিন পারলারের কর্মী, পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি এক নারীকণ্ঠের আহ্বানে শুক্রাবাদে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হলেন! পচে-গলে মরে যাওয়া এ সমাজ, যেখানে দেশের সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইডেন কলেজে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে হোস্টেলে সিট-বাণিজ্যের নামে অসহায় শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠে। আর তা শুনে সমাজের মানুষেরা মৌন থাকে। ফৌজদারি অপরাধের পরও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরল, সংগ্রামী, অভাবপীড়িত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে এসে যখন ক্ষমতার দম্ভের সামনে নিপীড়িত হতে বাধ্য হন, সে সমাজের সদস্যরা তখন কেমন বোধ করেন? 

মানুষ একদিন গ্রহান্তরে যাবে, কিন্তু নারী হয়তো উন্নতির শিখরে উঠতে গিয়ে একইভাবে পুরুষ কর্তৃত্ববাদের সম্মুখীন হবেন। সেই আদিম ভীতিই বয়ে বেড়াবেন, প্রতিনিয়ত নিজের শরীর পাহারা দেবেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক