বিচার বিভাগের সংস্কার ও জনক্ষমতায়ন

আইনের মাধ্যমেই স্বৈরাচারী সরকারগুলো জনগণের ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ‘পোষ মানানো’ প্রাণীতে রূপান্তর করে। ৩০ জুলাই ২০২৪ছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সমস্যাসংক্রান্ত প্রচলিত তর্কবিতর্কগুলোকে প্রধানত ক্ষমতার পৃথক্‌করণ বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসংক্রান্ত আলোচনায় সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও মামলাজট, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা না থাকা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতিসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার নির্বাহী বিভাগের কুক্ষিগত করে রাখা ইত্যাদি প্রসঙ্গও আসে ব্যাখ্যা হিসেবে, ‘বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণে’র নীতি বাস্তবায়ন না করার ফলাফল আকারে। ফলে বিচার বিভাগীয় সংস্কারসংক্রান্ত যেকোনো প্রস্তাব-ফর্মুলাও হাজির হয় একরৈখিক সমাধানের পথে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা শুনছি যে মাসদার হোসেন মামলার (১৯৯৯) রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলেই জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। পৃথক সচিবালয় হলে সুপ্রিম কোর্টের বাজেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসবে, অধস্তন আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা ই-জুডিশিয়ারি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সহজতর হবে।

এসব ফাংশনাল সমাধানের ওপর অতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা সংস্কারের মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নই আড়ালে চলে যাচ্ছে। কারণ, আইনি বিচারিক সংস্কারের প্রশ্ন আসলে জনগণের ক্ষমতায়নের প্রশ্ন। আধুনিক রাষ্ট্রে আইনের মাধ্যমেই জনগণকে ক্ষমতায়িত করা হয় অথবা ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ‘পোষ মানানো’ প্রাণীতে রূপান্তর করা হয়।

রাশেদ রাহম

আমাদের ইতিহাসে কীভাবে জনগণকে কর্তাসত্তাহীন অক্ষম জড়বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এবং তাতে বিচার বিভাগ কী ভূমিকা পালন করেছে, তার হদিস নেওয়া প্রয়োজন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। স্থানীয় পর্যায়ে বিচারিক কাঠামো থাকলেও তার বিস্তারিত বহর ছিল না। অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতের মাটি ও জনগণকে নিষ্পেষণ করে সম্পদ আহরণ করা। তাই খাজনা আদায়ের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে বিস্তৃত আইনি কাঠামো।

১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে জমিদারি ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা হয়, তা ছিল মানুষকে আইনের নিগড়ে বেঁধে ফেলার আয়োজন। জনগণ জুলুমের প্রতিবাদ করলে তাকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করে ফৌজদারি আইনের অধীনে আনা হয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আইনি কাঠামোকে আরও বিস্তৃত করা হয়, আইনের কোডিফিকেশন হয়, ফৌজদারি-দেওয়ানি-সাক্ষ্য ইত্যাদি প্রধান আইন প্রণীত হয়, ব্যক্তিগত আইনের নামে ব্যক্তির পারিবারিক-ধর্মীয় জীবনে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। আইন কেবল বলপ্রয়োগের অস্ত্র নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতাদর্শিক বৈধতার ভিত্তি হিসেবেও হাজির হয় ‘ব্রিটিশ ন্যায়বিচার’ বা ‘আইনের শাসন’, আইনি সমতা ইত্যাদি নামে। ঔপনিবেশিক আইনি আলোচনার বৈষম্যমূলক কাঠামোতে ‘দ্য গুড লিগ্যাল সাবজেক্ট’ বা আইন মান্যকারী প্রজা এবং ছোটলোক অপরাধীদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত ফারাক, তাতে উঁচুতলার কিছু মানুষ আইনের আশ্রয় পেল বটে, কিন্তু সর্বজনের জন্য আইন-আদালত রয়ে গেল ‘অবিচারের বাজার’ হিসেবে।

এই ‘অবিচারের বাজারে’র বড় সওদাগর শ্রেণি হিসেবে আবির্ভূত হয় ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোক-উপজাত উকিল-ব্যারিস্টার-আইনজীবী শ্রেণি। তাঁদের কাজ ছিল আরোপিত আইনি কাঠামোতে নাকাল প্রধানত পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ কৃষক-রায়তের হয়ে আদালতে প্রতিকার চাওয়ার বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর যখন পূর্ববঙ্গে স্বতন্ত্র হাইকোর্ট স্থাপনের দাবি ওঠে, সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ আসে কলকাতার ভদ্রলোক উকিলদের পক্ষ থেকে। বিস্তীর্ণ পূর্ববঙ্গের বিপুলসংখ্যক মক্কেল নষ্ট হবে, তা-ই ছিল এই উকিল শ্রেণির প্রধান বিবেচ্য। ৮০ বছর পর এরশাদের সামরিক সরকার যখন বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করল, তাতেও আদালতের অখণ্ডতার নামে সংবিধানের নামে এর বিরোধিতা করলেন এই ইংরেজি-শিক্ষিত আইনজীবী শ্রেণির প্রতিনিধিরা। এই আইনজীবী শ্রেণি থেকেই নিয়োগ পান আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারকেরা, উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের কথা বললে যারা কোর্টের রুলসের ধুয়া তোলেন। লিগ্যাল এইড বা সহায়হীনদের বিনা মূল্যে বিচারিক সেবা দেওয়ার প্রকল্প যে বাস্তবায়িত হয় না, তার পেছনে বড় কারণও তাঁদের অনীহা।

বাংলাদেশের আইনি সাংবিধানিক কাঠামোতে বিচারকেরা ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়মুক্তি উপভোগ করেন। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি সাংবিধানিক কাঠামো অনুযায়ী আইন বিভাগ বা সংসদ আইন প্রণয়ন করে, নির্বাহী বিভাগ তা নির্বাহ করে শাসনকাজ পরিচালনা করে। সংসদের আইন প্রণয়ন কিংবা সরকারের তা প্রতিপালনে কোনো ব্যত্যয় হলে, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের বিপরীত হলে বিচার বিভাগ, প্রধানত সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করতে পারেন। কেবল তা-ই নয়, সংসদ-প্রণীত আইনের বাইরে সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ের মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়ন করে, যা বিচারিক ‘নজির’ (প্রিসিডেন্ট) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে একই বিষয়ে পরবর্তী বিচারের গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। সংসদের আইন বা নির্বাহীর কোনো সিদ্ধান্ত বাতিল কিংবা আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়ন—এই সবই ঘটে বিচার বিভাগের বিশেষ ভাষা, কাঠামো ও কলাকৌশলের মাধ্যমে; যাতে জনগণের অংশগ্রহণ বা নজরদারি কোনোটারই সুযোগ থাকে না। ফলে রাষ্ট্রের মৌল চরিত্রকে বদলে দেওয়ার প্রভূত ক্ষমতা বিচার বিভাগের কাছেও থাকে, যার নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের ফলে জন্ম নিতে পারে জুরিস্টোক্র্যাসি, অর্থাৎ ‘বিচারকরাজ’ বা ‘বিচারকদের স্বৈরতন্ত্র’।

ইতিহাসে বিচার বিভাগ যেখানে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণের কারণে দমই ফেলতে পারেনি, সেখানে আমরা এখনই এসব প্রশ্ন তুলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নকেই বাধাগ্রস্ত করছি না তো? উত্তর হলো, না। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারকেরাই সবচেয়ে দায়মুক্তি উপভোগ করা পেশাজীবী শ্রেণি। আমাদের ইতিহাসে বিচার বিভাগের ভূমিকার কোনো রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হয়েছে কি? আমরা কি বিচারপতি মুনীরের (১৯৫৪-৬০) নাম জানি যিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈধতা দিয়েছেন কিংবা বিচারপতি মুনিম (১৯৮২-৮৯) যিনি এরশাদের সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার কারণে আইনজীবীদের লাগাতার কোর্ট বর্জনের পরও বছরের পর বছর প্রধান বিচারপতির আসন আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন? আমরা কি জানি না সেনা-তত্ত্বাবধায়কের আমলে স্বতন্ত্র বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের বিনিময়ে কী আইনহীনতা-অবিচারের অনুমোদন করতে হয়েছিল? কীভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে রাস্তার দাবিকে এজলাসের রায়ে পরিণত করার মাধ্যমে আদালতকে মাঠের রাজনীতির কাছে বন্দী করে ফেলা হয়েছিল? কীভাবে সামরিক আমলে আইনের বিধানের অন্ধ-আক্ষরিক অনুসারী ‘ফর্মালিস্ট’ বিচারকেরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো আমূল রাজনৈতিক প্রশ্নে চূড়ান্ত ‘অ্যাকটিভিজম’ দেখিয়ে বিচার বিভাগের চূড়ান্ত রাজনীতিকীকরণ করেছিলেন? কীভাবে বিচারপতিরা কোনো রেজিমের ‘শপথবদ্ধ সৈনিক’ হয়ে উঠেছিলেন? কিংবা এই প্রশ্নই কি আমরা করেছি যে, ২০০৭ সালে অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠার ফলে অপরাপর ক্যাডার সার্ভিসের তুলনায় বিচারকদের মান-মর্যাদা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া জনগণের বিচারপ্রাপ্তিতে কি দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে? এ ব্যাপারে কোনো জরিপ-প্রতিবেদন তো আমরা পাইনি।

অনেকে বলতে চাইবেন, বিচার বিভাগের পূর্ণ পৃথক্‌করণ না হলে এর কার্যকারিতার সুফল মিলবে না। বিচার বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে যেসব অসুবিধা হতো—নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতিতে প্রভাব বিস্তার, বিচার বিভাগের বাজেট সংকোচন, সর্বোপরি নির্বাহী নিয়ন্ত্রণে রেখে পদপদবি বিলানোর একচেটিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করা—এসব পৃথক সচিবালয় হলে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কী? আমলাতন্ত্র কেবল কিছু ব্যক্তির সমষ্টি নয়, বরং জনবিচ্ছিন্ন ও উচ্চম্মন্য প্রশাসকের সংস্কৃতি। ফলে এই বিচারিক আমলারা প্রভূত ক্ষমতা পেয়ে দুর্দমনীয় হয়ে উঠলে তার প্রতিষেধক কী?

পর্যাপ্ত নতুন বিচারক নিয়োগ দিলেই কি মামলাজটের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? মামলাজট কেবল পাকিস্তান-বাংলাদেশ আমলের সমস্যা নয়, ১৮৭০–এর দশক নাগাদ তা খোদ ব্রিটিশদেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ হলো ঔপনিবেশিক সর্বগ্রাসী বিচারব্যবস্থার জের, যেখানে ঔপনিবেশিক শাসনকে সর্বব্যাপী করার জন্য প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সব অনুষঙ্গকে আইনের, তথা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

ফলে আমাদের সামনে এখন একমাত্র খোলা পথ আইনি বিচারিক কাঠামোর বি–উপনিবেশায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ। আর সেটা করা সম্ভব সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রবাদী–ব্যবস্থার বদলে ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা ও সমষ্টির কর্তাসত্তা প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। সব সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রের আরোপিত কাঠামোতে না খুঁজে সমাজের কাছে ফিরে যাওয়া। উপায়ান্তর না দেখে আমরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ইত্যাদি নামে তা করার চেষ্টা করছি বটে। তবে এডিআর যে এখনো সমস্যার সমাধান হতে পারছে না, তার কারণ বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক আড়ষ্টতা; বৃহত্তর দার্শনিক অবস্থান, অর্থাৎ জনগণের ক্ষমতায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারিক সংস্কারের প্রশ্নকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থতা।

এই আড়ষ্টতার আগল ভেঙে বিচার বিভাগকে সমাজের আরও গহিনে পৌঁছাতে হবে। যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সেগুলোর শরণ নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ‘গ্রাম আদালত’ বা ‘পঞ্চায়েত’–ব্যবস্থাকে জোরদার করা এবং উপজেলা পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক বিচারের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক বিচারিক প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে জটিল দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলা ছাড়া সব বিবাদ-অভিযোগের নিষ্পত্তি বিচারব্যবস্থার এসব প্রাথমিক ইউনিট থেকে তুলে আনতে হবে। অধিকাংশ বিবাদ তো সামাজিক, তার নিষ্পত্তিও সমাজের ভেতর থেকে করতে হবে। ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রসিকিউশন বিভাগ এবং পুলিশ ও থানাব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার জরুরি। সবচেয়ে বেশি জরুরি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের ওপর জন–নজরদারি প্রতিষ্ঠার জন্য পার্লামেন্টারি কমিটি ধরনের রাজনৈতিক জবাবদিহির কোনো টেকসই মডেল আবিষ্কার করা। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কার্যকর জবাবদিহি-জনগণতান্ত্রিক বা মানবিক মর্যাদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই তো একমাত্র তরিকা।

* রাশেদ রাহম: আইনের ইতিহাস গবেষক