পর্যাপ্ত বিনিয়োগ কেন নয়

রাশেদা কে চৌধূরী

অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিষয়টির পরিসর অনেক বড়। এটা শুধু অপ্রাতিষ্ঠানিক অথবা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাই নয়, প্রকৃত অর্থে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনব্যাপী শিক্ষারই অংশ। 

আমি যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, যে কৃষক উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অন্য মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়ে থাকেন, তাঁর হয়তো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু জীবনে পেশাগত দক্ষতার অংশ হিসেবে এটাও তাঁর একধরনের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। সম্ভবত সেই কারণে ব্রাজিলের বিখ্যাত দার্শনিক পাওলো ফেইরি সব শিক্ষার ওপরে ‘নির্যাতিতের শিক্ষা’কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে যাঁরা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আমাদের চিন্তার জগতে নিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ অন্যতম। সেখানে আমরা লক্ষ করেছি, মোটামুটি আশির দশক থেকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা নানান আকার–প্রকারে অনুসৃত হয়েছে। প্রধানত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং দক্ষতাভিত্তিক মৌলিক শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এ দেশে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। এ ধরনের কার্যক্রমের আওতায় বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর (বিএইফ) একটি প্রকল্পে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। 

অন্যদিকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোথাও জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালাচ্ছে, আবার কোথাও কিশোর-কিশোরীদের সংগঠিত করে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ দুই খাত মিলিয়ে এ ধরনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ লক্ষাধিক।

আবার কিছু কিছু কার্যক্রম আছে, যেগুলো ১৫ বছর ঊর্ধ্ববয়সী সাক্ষরহীন জনগোষ্ঠীর মৌলিক শিক্ষা ও ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, এনজিও পরিচালিত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে কন্যাশিশু ও নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার এখনো উদ্বেগজনক, সেখানে দক্ষতাভিত্তিক
অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম একটি বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা গত দুই দশকে সেটাই লক্ষ করেছি।

কিন্তু বেশির ভাগ অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রধানত প্রকল্পভিত্তিক হয়ে থাকে। প্রকল্প শেষ হলে কর্মসূচিও থমকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে নতুন প্রকল্প শুরু করা সম্ভব হলেও সময়ক্ষেপণের কারণে এর ফলাফল টেকসই হয় না। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সরকারি পর্যায়ে অনেক সময়ই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ, যেমন বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমের মতো বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে যারা ভুক্তভোগী, তাদের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করাও সম্ভব হয় না। এর সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো, কোভিডকালে আর্থসামাজিক কারণে যাদের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে, শর্ত সাপেক্ষে যদি তাদের উপবৃত্তির টাকা বহাল রাখা হতো, তবে অনেকেই হয়তো শিক্ষাঙ্গনে ফিরত। তবে সব ধরনের পরিকল্পনার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হয় বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত, যার অভাব প্রায়ই প্রকটভাবে দেখা যায়। ফলে সরকারি-বেসরকারি যেকোনো পর্যায়েই সঠিক পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

শিক্ষার যেকোনো আঙ্গিকে, সেটা প্রাতিষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক, যেটাই হোক না কেন, তার জন্য তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনার সঙ্গে আরেকটি বড় প্রয়োজন হলো, যথার্থ বিনিয়োগ। কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জিডিপির হারে বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য
নিম্নতম! আমরা একদিকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, সংগত কারণেই বিশাল বিশাল মেগা প্রকল্প এবং অবকাঠামো উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছি। 

কিন্তু মানবসক্ষমতা বিনির্মাণ না হলে অনেক উন্নয়ন টেকসই না হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ বিনিয়োগ যেমন দরকার, তেমনি বিনিয়োগের স্বচ্ছ ও যথার্থ ব্যবহারও অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ কোভিডসহ নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ ও ঝুঁকি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। শিক্ষার সব ধরনের ঝুঁকি প্রশমন করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিশ্চয় আরও সম্ভাবনার দিকে এগোবে, এটাই বর্তমানের প্রত্যাশা।

লেখক: গণসাক্ষরতা অভিযান–এর নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা