অভিবাসনে আমাদের অনন্য অর্জন

মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।

আসিফ মুনীর

আমাদের এ অঞ্চলে অভিবাসনের গোড়াপত্তন স্বাধীনতার আগে পঞ্চাশের দশক থেকেই।

নৌপথে দীর্ঘ পথযাত্রার হাতছানিতে সিলেট ও নোয়াখালীর উদ্যমী, সাহসী, কর্মঠ তরুণ পুরুষেরা গিয়ে উপস্থিত হতো ইউরোপের বিভিন্ন উপকূলে। কেউ হয়তো জাহাজের কর্মী, কেউ কর্মের সন্ধানে জাহাজে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালির উপকূলে বাংলাদেশের মানুষের বসবাস তাই কয়েক প্রজন্ম ধরে।

পরবর্তী সময়ে সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রম অভিবাসন শুরু হয়। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর ১৭৩টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ আছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই শ্রম অভিবাসী। অন্য দেশের কথা চিন্তা করলে, বিশেষ করে ইউরোপের ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স—এসব দেশে খুব অল্প কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেশ ভালো পরিমাণেই আছে। এ ছাড়া কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্ত আছেন বিভিন্ন পেশায়।

স্থায়ী অভিবাসীদের মধ্যে যাঁরা চাকরি কিংবা বিভিন্ন ধরনের পেশায় আছেন, তাঁদের পরিবারের অনেককেই তাঁরা সেখানে নিয়েছেন এবং তাঁদের উপার্জন সেখানেই বিনিয়োগ করছেন।

আমাদের দেশের শ্রমবাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৭ লাখের মতো মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যান এবং তাঁদের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো নারী শ্রমিক। পরিসংখ্যান বলে, দেশের প্রায় ৮ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য অভিবাসী। মোট অভিবাসীর শতকরা ৮০ ভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁরাই পরিবারের মূল উপার্জনকারী। গত ৫০ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই শ্রম অভিবাসীদের বড় একটি অবদান আছে এবং আমাদের দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে এই শ্রমজীবীদের মাধ্যমে। কারণ, তাঁরা খণ্ডকালীন কাজ করেন ও কয়েক বছর পর দেশেই ফেরত আসেন। শিকড় দেশেই রেখে যান।

স্থায়ী অভিবাসীদের মধ্যে যাঁরা চাকরি কিংবা বিভিন্ন ধরনের পেশায় আছেন, তাঁদের পরিবারের অনেককেই তাঁরা সেখানে নিয়েছেন এবং তাঁদের উপার্জন সেখানেই বিনিয়োগ করছেন। এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম এবং তাঁরা সব সময় যে নিয়মিতভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান, তা নয়। পুরুষ কিংবা নারী উভয়েই, বিদেশে যে কাজই করুক না কেন, বাংলাদেশ আসার সময় কিছুটা হলেও সেখান থেকে দক্ষতা অর্জন করে আসেন। সঙ্গে ওসব দেশের সংস্কৃতি, ভাষাও সঙ্গে নিয়ে আসেন। অনেক সময় দেখা যায় যেসব শ্রমজীবী মানুষ দেশের বাইরে নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা ফেরত আসার পর আমাদের দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে যুক্ত হয়ে তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগাচ্ছেন।

আবার ফেরত আসার পর স্থানীয়ভাবে ছোটখাটো উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক সময় কাজ করেন। ছোট কোনো ব্যবসা বা নিজের এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে কিছুটা কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেন। তাই শ্রম অভিবাসন সামগ্রিকভাবে কিছুটা হলেও বেকারত্বের জায়গাটা কমাতে ভূমিকা রাখছে।

পুরুষ কিংবা নারী উভয়েই, বিদেশে যে কাজই করুক না কেন, বাংলাদেশ আসার সময় কিছুটা হলেও সেখান থেকে দক্ষতা অর্জন করে আসেন। সঙ্গে ওসব দেশের সংস্কৃতি, ভাষাও সঙ্গে নিয়ে আসেন।

নারীর ক্ষমতায়নেও শ্রম অভিবাসনের ভূমিকা আছে, যদিও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমাদের মোট শ্রম অভিবাসীর মধ্যে ১২ শতাংশ নারী। তাঁদের অনেকেই বিধবা অথবা পরিবারের মধ্যে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি, কিংবা স্বামী অসুস্থ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো স্বামী পরিত্যক্ত কিন্তু সন্তান আছে, মোটকথা পরিবারের দায়িত্ব আছে তাঁদের কাঁধে। নারী শ্রমজীবীরা পুরুষের তুলনায় বেশি অর্থ বা রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বাসাবাড়িতে কাজ করেন এবং সেখানে তাঁদের সীমাবদ্ধতাও থাকে। ফলে বাইরে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করার সুযোগ থাকে না। তারপর তাঁরা যখন দেশে ফেরত আসেন, তখন কিছুটা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় থাকেন।

এই শ্রমজীবী মানুষের জন্য সুষ্ঠু অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি দপ্তর আছে—জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এই বোর্ড গঠিত হওয়ার কারণে শ্রমিকদের অধিকার আর তাঁদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদেশ গমনের বিষয়গুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়েছে। প্রতিবছর এই মন্ত্রণালয়ের জন্য আমাদের রাজস্ব বাজেটে বরাদ্দ থাকে, যদিও অপ্রতুল। আমাদের নীতিনির্ধারণী কাঠামোতে নিয়মিতভাবে অভিবাসন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে বর্তমানে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আছে, সেটিতে এবং সপ্তমেও ছিল। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কর্মপরিকল্পনাতেও শ্রম অভিবাসন অন্তর্ভুক্ত আছে।

বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ, বিশেষ করে যুদ্ধ–পরিস্থিতিতে অভিবাসীরা বাইরের দেশে সংকটে পড়েন, তাঁদের তখন সহায়তা করার মতো দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করেছি। ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সরকারি উদ্যোগে ফেরত আনা হয়েছিল। ২০১১ সালে যখন লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখনো প্রায় ৩৭ হাজার বাংলাদেশিকে বিভিন্ন পর্যায়ে ফেরত আনা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ইউরোপ বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য অস্থায়ীভাবে লিবিয়ায় যাওয়ার পর যাঁরা সংকটে পড়েছেন, তাঁদের খোঁজখবর নেওয়া কিংবা সহায়তা দিয়ে তাঁদের পাশে থাকার উদাহরণও আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনাকালীন বিধিনিষেধের সময় বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ সরকার দূতাবাসের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা এবং করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল।

গত ৫০ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনে শ্রম অভিবাসীদের বড় অবদান আছে এবং দেশে প্রবাসী রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসে তাঁদের মাধ্যমে
ছবি: প্রথম আলো

করোনার সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অনেক শ্রমজীবী মানুষ সাময়িকভাবে ছুটিতে এসে দেশে আটকা পড়েছিলেন। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে আবারও তাঁদের পাঠানোর ব্যাপারে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিভিন্ন এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমজীবীদের কাজে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সে সময় বিদেশে যাওয়ার জন্য করোনা পরীক্ষা এবং টিকা বাধ্যতামূলক ছিল। তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে আসে। যাওয়ার আগে পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে যেন তাঁরা যেতে পারেন, এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক ছিল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে সরকার তখন বড় ভূমিকা রাখতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা করোনার সময় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইমিগ্রেশন বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ দেখেছি, যা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বড় ধরনের যখন দুর্যোগ যখন আসে, তখন আমরা অভিবাসীদের জন্য কিছুটা হলেও সেই দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছি।

সাম্প্রতিক কালে ইউরোপ বা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য অস্থায়ীভাবে লিবিয়ায় যাওয়ার পর যাঁরা সংকটে পড়েছেন, তাঁদের খোঁজখবর নেওয়া কিংবা সহায়তা দিয়ে তাঁদের পাশে থাকার উদাহরণও আছে।

এই বিশেষ দুর্যোগ বা জরুরি অবস্থার জন্য নীতিমালা তৈরি রাখা বা কিছু স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) এখন প্রক্রিয়াধীন। সেটাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা যায়, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের জরুরি অবস্থায় বিদেশগামী শ্রমিককে যেকোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে। হোক সেটা বিদেশে থাকা অবস্থায় কিংবা বিদেশ যাত্রাকালে এবং দেশে ফেরত আসার পর। করোনা–পরবর্তী সময় যাঁরা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুদিক থেকেই কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, তার নীতিমালাও প্রক্রিয়াধীন।

করোনাকালে যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের নীতিমালা প্রক্রিয়াধীন
ছবি: প্রথম আলো

সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কল্যাণ বোর্ডকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করার চেষ্টা করছে। সেখানে ফেরত আসা কর্মীদের জন্য বিভিন্ন রকম সুযোগ–সুবিধা থাকবে। তাঁরা যদি কোনো রকম ব্যবসায়িক কিংবা পেশাগত উদ্যোগ নিতে চান বা পেশায় যুক্ত হতে চান, তার পরামর্শ দেওয়া হবে। তাঁরা যদি নিজস্ব সঞ্চয় অথবা কোনোরকম ঋণ নিয়ে কোনো কাজ করতে চান বা উদ্যোগ নিতে চান, তাহলে সহজ শর্তে কোথায় ঋণ পাবেন, সেটার ব্যবস্থা করা হবে। যাঁরা সংকটে পড়ে ফেরত আসছেন, তাঁদের এককালীন কিছু অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার মতো কিছু প্রক্রিয়া এখন চলমান।

রেমিট্যান্স পাঠালে প্রবাসীদের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন। অবৈধ মাধ্যমে টাকা পাঠালে হয়তো একজন শ্রমজীবী কিছুটা নামমাত্র সুবিধা পান, কিন্তু এই সুবিধা নেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্য একজন দেশের টাকা পাচার করার সুযোগ পায়।

অভিবাসন ক্ষেত্রে একসময় হাতে লেখা পাসপোর্টের বড় জটিলতা ছিল। আগে প্রায়ই ‘গলাকাটা পাসপোর্ট’ বলে একটা কথা শোনা যেত। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির পাসপোর্টে ছবি কিংবা নাম পরিবর্তন করে অন্যের নামে ব্যবহার। সেই পাসপোর্ট পরীক্ষা করার মতো কারিগরি ব্যবস্থা সরকারের ছিল না। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্টের দিকে যাওয়ার কারণে, বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সংকটে পড়ে দূতাবাসে যোগাযোগ করলে দূতাবাস অন্তত সরকারি তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে তাঁদের চিহ্নিত করতে পারছেন।

অভিবাসনের যেহেতু ব্যবসায়িক দিক আছে, তাই এটি নিয়মতান্ত্রিক করতে গেলে যাঁরা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কিছুটা আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সাম্প্রতিক কালে গত কয়েক বছরের মধ্যে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩’, ‘প্রবাসী কর্মসংস্থান নীতিমালা ২০১৬’, ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী ব্যবস্থাপনা ২০১৭’, ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮’ এবং আরও কিছু আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আছে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী (রিক্রুটিং এজেন্ট লাইসেন্স ও আচরণ) বিধিমালা ২০১৯’। প্রবাসী বাংলাদেশিদের আর্থিক সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ও ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। যদিও এর অর্জন তুলনামূলক কম, তবে সম্ভাবনা আছে।

অভিবাসনের যেহেতু ব্যবসায়িক দিক আছে, তাই এটি নিয়মতান্ত্রিক করতে গেলে যাঁরা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কিছুটা আইনের আওতায় আনার জন্য সরকার রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্যভান্ডার তৈরি করেছে। তাঁদের শ্রেণিবদ্ধকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা এবং সেই তথ্যভান্ডারের ভিত্তিতে। যেসব এজেন্সি নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভিবাসনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন, তাঁদের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্মানিত করা সম্ভব। আবার যাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে করছেন না, তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কোনোরকম পদক্ষেপ নেওয়ার থাকলে সেটাও সহজ হবে।

অভিবাসনপ্রক্রিয়া অনিয়মতান্ত্রিক হওয়া এবং এতে কিছু সংকট থাকার ফলে একধরনের মধ্যস্বত্বভোগী দালালচক্রকে দায়ী করা হয়। যেহেতু আমাদের গ্রামাঞ্চলে সরকারেরও অভিবাসন কর্মকাণ্ড সীমিত, আবার রিক্রুটিং এজেন্সিরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই সেখানে দালালদের একটা দৌরাত্ম্য থাকে। দালালেরা যেভাবেই কাজ করুক না কেন, তারা যদি একেবারেই কোনোরকম ভূমিকা না রাখত, তাহলে কিন্তু আমাদের এই অভিবাসন খাতটা সামনের দিকে এগোতে পারত না৷ কাজেই এটা আদতে একটা উভয়সংকটের মতো ব্যাপার। দালালেরা নিয়ম কিংবা আইনের আওতায় নেই, কিন্তু তাদের ছাড়া চলেও না। কয়েক বছর ধরে ২০১৩-এর আইনটিকে সংশোধন করে কীভাবে দালালদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে দালালদের কাজ করার বিষয়টি কিছুটা নিয়মতান্ত্রিক হবে এবং আইনের দ্বারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রক্রিয়ার মধ্যে কীভাবে অভিবাসন বিষয়টি আনা যায়, সে লক্ষ্যে ২০১০ সালের শুরুতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন রেমিট্যান্স কোন চ্যানেলে আসে এবং ওই রেমিট্যান্সের ব্যবহার কীভাবে সেটি খতিয়ে দেখা হয়, তবে সেটা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, সেই প্রক্রিয়ায় সঠিক তথ্য পাওয়া একটু কঠিন৷ কারণ, যাঁরা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে কোনো মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, এই তথ্য দিতে চাইবেন না। যে কারণে সেসব পরিসংখ্যান বৈজ্ঞানিকভাবে নেওয়াটা কঠিন। ২০২২ সালে লেবার ফোর্স সার্ভে হয়েছে, সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে শ্রম অভিবাসনকে। জাতীয় পরিসংখ্যানের মধ্যে আমাদের অভিবাসীদের সংখ্যা কত এবং নারী–পুরুষের অনুপাতের মতো তথ্য আমরা এখন পাচ্ছি, যা আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজে লাগবে।

বিগত এক দশকে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরাসরি অভিবাসীদের বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে আংশিক সাফল্য দেখা গেছে। যদিও এই প্রক্রিয়ায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানুষ বিদেশে যেতে পারছে। ফলে ভুক্তভোগীর সংখ্যাও অনেক কম এবং এই প্রবাসীরা ভালোভাবেই আয়–উপার্জন করতে পারছেন। সরকারের অনুমতিতে বেসরকারি উদ্যোগে যখন মানুষ বিদেশে যাচ্ছে, তখন কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সিন্ডিকেট তৈরি হয়। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমেই কেবল তাদের বিদেশে পাঠাতে হয়। প্রবাসী বাংলাদেশি ও সরকারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা আছেন, তাঁদের কারণে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভিবাসীরা যখন বিদেশ যাচ্ছেন, তাঁর একটা তথ্যভান্ডার আছে। কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যেমন অনেক সময় দেখা যায় কোনো একটি দেশের ভিসা নিয়ে তাঁরা অন্য আরেকটি দেশে গিয়ে স্থায়ী হচ্ছেন। সে জন্য একটি দেশে কতজন বাংলাদেশি আছেন, যেকোনো সময় সেটা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন।

তবে সরকারি উদ্যোগে যা হয়েছে, তা যদি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হিসেবে ধরে ভবিষ্যতে আমরা আরও চেষ্টা করি, তাহলে দেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে শ্রম অভিবাসনকে একটি ভালো পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া সরকার নিজস্ব উদ্যোগে সংখ্যায় কম হলেও জাপান ও কোরিয়ার মতো কিছু দেশে সেমি প্রফেশনাল লোকবল পাঠানোর চেষ্টা করেছে। সে ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য অবশ্যই আছে। কারণ, সেখানে সরকারের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক আছে। চুক্তিভিত্তিকভাবে শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য গত ১০ বছরে বেশ কিছু সাফল্য এসেছে। এটাকে হয়তো ভবিষ্যতে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন দেশে শ্রম অভিবাসীদের বাজার কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে বেশ কিছু পর্যালোচনা হয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ আফ্রিকার বেশ কটি দেশ, এমনকি ইউরোপে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সরকারি প্রতিনিধিদলও গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা থেকেও তাদের প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছে, এসবের কিছু প্রতিবেদনও তৈরি হয়েছে। সেগুলোর ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও শ্রম অভিবাসন সম্প্রসারণ সম্ভব।

তবে মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক শ্রমবাজারে যে ওঠানামা হয়, তা বিশ্ব অর্থনীতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার আজ যেখানে সম্ভাবনা নিরূপণ করলাম, হয়তো আগামী পাঁচ বছর তা একই অবস্থায় থাকবে না। কাজেই এটা নিয়মিত প্রক্রিয়াকরণ দরকার। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দূতাবাসে আমাদের যে শ্রম কর্মকর্তা নিয়োগ পান, তাঁদের প্রতি একটি নির্দেশনা দেওয়া আছে। তাঁরা ওখানে বিদেশে শ্রমবাজার নিরূপণ করার চেষ্টা করবেন, তারতম্য হলেও বোঝার চেষ্টা করবেন, এমনকি সুনির্দিষ্ট তথ্য, যেমন কোন পেশায়, কোন ধরনের কাজে, কোন ধরনের কোম্পানিতে, কী ধরনের লোক দরকার, তা জানার চেষ্টা করবেন। শ্রম কর্মকর্তারা তাঁদের প্রতিবেদন যেন রিয়েল টাইমে দিতে পারেন, সে জন্য অনলাইন সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। কোনো একজন কর্মকর্তা যদি কারখানা পরিদর্শনের সময় ছবি সিস্টেমে আপলোড করেন, কবে গিয়েছিলেন, কী দেখলেন, সেখানে কারও সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়ে থাকলে সিদ্ধান্তগুলো ওই দিনই অনলাইন সিস্টেমে তুলে দেন, তাহলে এটা আমাদের মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে দেশে বসে দেখতে পারবে। এ ধরনের কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সুপারিশ থাকে, তা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমাদের দেশের জন্য অভিবাসী শ্রমবাজার হয়তো কিছুটা বাড়বে।

বিশ্বের বিভিন্ন শ্রমবাজারের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে শ্রম অভিবাসীদের কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রের আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতিতে শুধু লেকচারের মাধ্যমে নয়, প্রয়োজনে বিভিন্ন রকম অডিওভিজ্যুয়াল উপকরণ ব্যবহার করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে যাঁরা দক্ষ, তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে। যাঁরা নতুন করে যেতে চাইবেন, তাঁদের এখানে সরাসরি হাতে–কলমে শেখাতে পারবেন। এটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, অবশ্যই এর ফল আমরা পাব। যাঁরাই এখান থেকে যাবেন, শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, গুণগত দিক থেকেও উন্নত হবেন। ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে আদতে সেই জায়গাটাই দরকার। কেননা এটা একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার।

সব মিলিয়ে শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি নগণ্য তো নয়ই, বরং বিগত ২০ বছরে অগ্রগতি অভাবনীয়। বাংলাদেশের শ্রমজীবী তরুণ সৎ, কর্মঠ ও মেধাবী। সরকারের কাছে শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ক্রমে গুরুত্ববাহী। একদিকে আধুনিক মনস্ক দক্ষতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে শ্রমবাজার বৃদ্ধি এবং আইন-নীতিমালার প্রয়োগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি বেগবান হবে।

আসিফ মুনীর, অভিবাসনবিশেষজ্ঞ