জলবায়ুর ঝুঁকি বিবেচনায় হোক উন্নয়ন ভাবনা

হাসিন জাহান

জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্ঞান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে, এ জন্য জলবায়ুকে ঘিরে নিত্যনতুন উপলব্ধি, গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সব পর্যায়ে প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট, যা বিশ্বের সব দেশ ও অঞ্চলকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। জার্মান ওয়াচের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের মতো বদ্বীপ অঞ্চলের জন্য এটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিগত বছরগুলো থেকে আমরা বেশ কিছু পরিবর্তন দেখতে পারছি, যেমন ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা ইত্যাদি।

গত ১৫ থেকে ৩০ বছরের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, এসব সমস্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এবং প্রতিবছর আরও বাড়ছে। এর পাশাপাশি নানা ধরনের মানবসৃষ্ট কারণেও পরিবেশ ও জলবায়ু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা প্রতিবছর একটু একটু করে সেই পর্যায়ে যাচ্ছি, যখন এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দিন দিন আরও জটিল আকার ধারণ করবে।

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলো ছয়টি ভাগে বিভক্ত—উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ এলাকা, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা এবং নগর অঞ্চলগুলো।

একেকটি অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব একেক রকম। যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের একটি অন্যতম সমস্যা হলো মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিরূপ আচরণের প্রভাবে এই লবণাক্ততা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাচ্ছে এবং ফলে সেখানে সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, মানুষের বাস্তুচ্যুতি, কাজের অভাব ইত্যাদি আরও প্রকট হচ্ছে। একই সঙ্গে ঘন ঘন সাইক্লোন ও বন্যার জন্য আমাদের বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, যা পরবর্তী সময় সামাল দেওয়া সহজ হবে না।

এ ছাড়া বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে, তা অর্জন করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন নিরসনে প্রশমন ও অভিযোজন—এ দুই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একসঙ্গে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে এবং গোটা বিশ্বের কাছে নিজেদের প্রয়োজন ও অর্জন তুলে ধরতে হবে।

শুধু অভিযোজন করেই কোনো দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে পারবে না
ছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হলো, উন্নত দেশগুলোর ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে করা কার্বন নিঃসরণ। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। নাসার গডার্ড ইনস্টিটিউট অব স্পেস স্টাডিজের তথ্যমতে, ১৮৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আমাদের বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে এই কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব, যাকে প্রশমন বলা হয়। এটি করতে মূলত পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তিগুলোয়।

কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম। কিন্তু এরপর কার্বন নিঃসরণ কমানোর দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকটি প্রশংসনীয় কাজ করে চলেছে, যেমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সবুজ উন্নয়ন সমন্বিত করা, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ সোলার হোম সিস্টেম প্রোগ্রামের মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রামীণ পরিবার এখন বিদ্যুৎ পেয়েছে।

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের এসব প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াকে বলা হয় অভিযোজন, যা নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোর কাজ। যেমন লবণসহিষ্ণু ধানের প্রজাতি উদ্ভাবন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার্য পানির অভাব পূরণ, বন্যাপ্রবণ এলাকায় পানির ওপর ফসল ও সবজির চাষ করা (অ্যাকুয়াপনিকস) ইত্যাদি অভিযোজন হিসেবে বলা যেতে পারে।

কিন্তু শুধু অভিযোজন করেই কোনো দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে পারবে না। কারণ, এর মাত্রা সীমিত। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে একটি ভারসাম্য রেখে প্রশমন ও অভিযোজন—এ দুটি করা প্রয়োজন।

অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সক্ষমতা কম। এ কারণে জলবায়ু দূষণকারী দেশগুলোর অন্যতম দায়িত্ব আমাদের মতো দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নের মধ্য দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু ধনী দেশগুলো তাদের কথা রাখে না। তাই নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমাদের দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

এসব সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার উন্নয়ন নীতিমালাগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সমন্বয় করে চলেছে। পাশাপাশি নিজস্ব উৎস থেকে জলবায়ু তহবিল গঠন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দ করে বাংলাদেশ সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেমন বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গঠন করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কীভাবে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারি।

আমাদের দেখতে হবে, তরুণদের কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি। পরবর্তী প্রজন্মই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল শিকার হতে চলেছে।

সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আরও কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেমন ‘ভিশন ২০৪১’ ও ‘বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০’ যার বিশদ পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের আরও একটি অর্জন হলো জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-২০৫০) তৈরি করা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনকে সমন্বিত করতে সহায়তা করবে।

এই নীতিমালাগুলোর মূলধারায় জলবায়ু পরিবর্তনকে সমন্বিত করা হয়েছে এবং তার জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। বিগত অর্থবছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার উদ্যোগ তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২৫টি মন্ত্রণালয়ের জন্য ২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। তবে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-২০৫০) বাস্তবায়ন করতে প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এই পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ চিত্র বিবেচনা করে সঠিক নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে দেশের পানিসম্পদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বব্যাপী যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে পানি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, পানির জন্য ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই দৈনিক ব্যবহার্য পানির তাৎপর্য চিন্তা করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘পানিনিরাপত্তা’ একটি প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।

যেমন ওয়াটারএইডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্যোগ-পরবর্তী সংস্কারে সরকারকে যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে যদি শুরুতেই জলবায়ু-সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ করা হতো, তবে প্রতি এক মার্কিন ডলার ব্যয় করলে দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যয় থেকে প্রায় পাঁচ মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা যেত।

এবার আসি খাওয়ার পানির ব্যাপারে। বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৮ অনুযায়ী, খাওয়ার পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে তার ব্যাপক কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। এখনো দেশের খরাপ্রবণ ও পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিবছর পানির সংকট দেখা যায়। উপকূলীয় জনগণ ঢাকা শহরের মানুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি পানির মূল্য প্রদান করেন।

এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিচ্ছে পানি উৎসের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনা। বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি অনাবৃষ্টি, কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে নিচে চলে যাওয়া, ঘন ঘন বন্যা, উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য একসময় দৈনন্দিন জীবনে পানির অভাব হবে অত্যন্ত প্রকট।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে পানিনিরাপত্তার ওপর আরও জোর দেওয়া দরকার। লোনাপানি পান ও ব্যবহারের প্রভাবে সবাই কমবেশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ে এবং নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও অনেক বেশি। দক্ষিণ অঞ্চলের নারীরা মাসিক কালে, সন্তান জন্মদানের আগে ও পরবর্তী সময়ে নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভোগেন শুধু লোনাপানি পানের কারণে।

কিন্তু আমরা জানি না ঠিক কতজন নারী এ সমস্যায় ভুগছেন এবং ভবিষ্যতে কতজন এ ঝুঁকিতে পড়বেন। আবার পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরে হেঁটে যেতে হয় এবং ফিরে আসতে হয়। এর পেছনে দিনের একটি দীর্ঘ সময় ব্যয় হয় এবং নারীরা পরিবারের পানির জোগান দিতে গিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে পিছিয়ে থাকে।

ফলে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে না বললেই চলে। মেয়েরা স্কুল কামাই করে মায়েদের পানি আনতে সাহায্য করে এবং পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে। এগুলো বাস্তব উদাহরণ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

আমাদের দেশে এখন জলবায়ু ও এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করা দরকার, যেখান থেকে নতুন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে স্পষ্ট প্রমাণসহকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের নীতিনির্ধারকদের।

একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোর জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের এবং তাদের মধ্যে বাজেট বরাদ্দের সমন্বয় সাধন করা অতি প্রয়োজনীয়, যাতে স্থানীয়ভাবে কোন খাতে কত বরাদ্দ দরকার, তা অনুধাবন করা যায়। এর থেকে পরবর্তীকালে বুঝতে পারব যে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কতটুকু এগোতে পেরেছি।

আমাদের আরও দেখতে হবে, তরুণদের কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি। পরবর্তী প্রজন্মই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল শিকার হতে চলেছে। সবশেষে বলা যায়, ২০৩০ সালের ভেতর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিকারের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা, অর্থায়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।

হাসিন জাহান: ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর।