প্রথম আলো জীবনের আলো

১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের পরিবারের প্রতিদিনের প্রাতরাশের একটি অংশ ছিল পত্রিকা। আর তা ‘চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিব’ বিনিময়ের মাধ্যমে বাসায় সবার হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি ছিল আমার। সেদিন ভোরের আলো ফুটতেই চোখ ডলতে ডলতে পত্রিকাপাড়ায় গিয়ে চোখটা আটকে গেল একটা জায়গায়। প্রথম আলোতে একটা জ্বলজ্বলে সূর্য। নামটাই এমন, বললাম, ‘আংকেল, এই পত্রিকাটা দিন।’ সেই থেকে আজীবনের যাত্রা শুরু।

পিথাগোরাসের উপপাদ্য ডিঙিয়ে, উচ্চশিক্ষার দ্বার পেরিয়ে, স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে হাঁটা শুরু করলাম একটু ভিন্ন পথে। এবার বিনিময় প্রথা পাল্টে গেল। আরাধ্য কাজের বিনিময়ে সেই ‘চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিব’ অর্জন করতে প্রথম আলোতে পেশাগত যাত্রা শুরু করলাম। ঘোর কাটল, বছর ঘুরল, যুগটাও ছোঁবো শিগগিরই। অর্থাৎ, এখন আমি যৌবন পেরিয়ে মধ্যবয়সের মোহনা পার করছি। পার করে আসা সময়টিতে ঘটে যাওয়া কিছু অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়।

কথায় আছে, পেশাগত জীবনের সঙ্গে নাকি ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করে রাখতে হয়। কিন্তু জীবন কী আর এত নীতিকথা মানে! পারিবারিক এক মিথ্যা মামলায় (পরে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে) আমাকে যেতে হলো জেলে। মনে হলো, এই বুঝি ইতি হলো ‘আমার জার্নি বাই প্রথম আলো’জীবন। কারণ, আমার কোনো আ-প্রত্যয় মানে আত্মীয় বা আশা ছিল না। কিন্তু সিনেমার পরিচালক তো আর অত কাঁচা নন, যিনি আমাদের বানিয়েছেন। চিত্রপটে পাঠিয়ে দিলেন আলোর দিশারিদের। আমার কয়েক সহকর্মীর দিনরাত শেষ না দেখে ছাড়ার প্রত্যয় থেকে ১৪ দিনের মাথায় তাঁরা আমাকে ছিনিয়ে আনলেন সেই কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে। আমার নতুন জীবনে শিখলাম, প্রথম আলো উপপাদ্য। যদি গণিতবিদ হতাম, কতই-না ভালো হতো!


জীবনের অমন তিক্তমধুর অভিজ্ঞতার খুব বেশি দিন পরের কথা নয়। এক দিন রাত সাড়ে দশটার দিকে এফডিসি গেট পেরিয়ে বাসায় যাচ্ছি, রিকশায় চড়ে কানে হেডফোনে গান শুনতে শুনতে। তখনই অফিস থেকে আমার বিভাগীয় প্রধান ফোন করে আরেকটু সময়ের জন্য অফিসে যেতে অনুরোধ করলেন। রিকশাটা ঘুরিয়ে নিতেই দুটি মোটরসাইকেল এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়াল। গানের মধ্যে ডুবে থেকে আমি শুধু নির্বাক তাকিয়ে আছি। পেছনের মোটরসাইকেল থেকে একজন (আমার চেয়েও কালো ও মোটা) নেমে আমার পেটে একটি চকচকে ছুরি ধরে কী যেন একটা জিজ্ঞাসা করল। আমি কানের হেডফোন খুলে বললাম,‘জি ভাইয়া?’ তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কই যাস?’ কী একটা বুঝে যেন আমি শুধু বললাম, ‘প্রথম আলোতে যাই।’ আর মনে মনে প্রস্তুত থাকলাম ছুরি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে কমপক্ষে একটা লাথি হলেও মারবে। লোকটার হলুদ চোখ দুইটা ২-৩ সেকেন্ড মনে হয় আমাকে দেখল, তারপর আমার রিকশাওয়ালাকে কষে একটা চড় মেরে, ‘রাস্তায় দেইখখা চালাইতে পারোস না….এই চল চল.. প্রথম আলো!’ বলেই মোটরসাইকেল নিয়ে ভোঁ টান দিল।

বলা যায়,  প্রথম আলো আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো বাঁচিয়ে দিল। কিছুদিন আগে ব্র্যান্ড আর্কিটাইপ নিয়ে একটা প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, প্রথম আলো আসলে কী টাইপের ব্র্যান্ড, আর সেটি হলো ‘হিরো’। যখন তিনি বলছিলেন, তখন আমার চোখে ভাসছিল ওপরের কথাগুলো। জানি না আর কত দিন থাকব প্রথম আলোতে। তবে আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলো হয়ে থাকবে আমার ‘হিরো’ প্রথম আলো।

লেখক: ব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ বিভাগ