অন্যদের খেলানো তাঁর নেশা

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খেলাধুলার আয়োজন করেন শারমিন চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

তিন বছর আগে ঢাকার এক মাঠে তাঁকে প্রথম দেখি। বস্তি আর পথশিশুদের জড়ো করে খেলাতে নিয়ে এসেছেন। শিশু–কিশোরেরা খেলছে আর তিনি বসে দেখছেন। ‘অন্যদের খেলানো—এমন অদ্ভুত স্বপ্নও মানুষের থাকে?’ দেখে মনে এই প্রশ্নের উদয় হয়েছিল। 

স্কুলে পড়ার সময় বাস্কেটবল, ভলিবল, বেসবল খেলতেন শারমিন ফারহানা চৌধুরী। বড় হয়েও খেলাধুলার প্রতি সেই ভালোবাসাটা রয়ে গেছে, সেই ভালোবাসা থেকেই এখন অন্যদের জন্য খেলাধুলার আয়োজন করেন। ‘অন্য’ বলতে সুবিধাবঞ্চিত শিশু, গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়ে, প্রতিবন্ধী, বাড়ির ঝি–বউ, বয়স্ক মানুষ। আর ‘আয়োজন’ মানে বিনা খরচে এক দিনের খেলার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে বড় প্রতিযোগিতা, সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশে বিনিময় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ।

এই আয়োজনগুলোকেই আরও সংগঠিতভাবে করতে ২০১৬ সালে শারমিন গড়ে তোলেন স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি)। ঢাকার গুলশানে তাদের কার্যালয়। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিও সাঁতার কাটতে পারেন, হুইলচেয়ারে বসেও খেলতে পারেন টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, ভলিবল।

বড় স্বপ্নের হাতছানি

শারমিন এখন হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ নিয়ে ব্যস্ত। স্কটিশ প্রতিষ্ঠান হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে গৃহহীন শিশুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ফুটবল দল গড়ে তুলবে শি। দলটি ২০২৩ সালে গৃহহীনদের বিশ্বকাপে খেলবে। ভেন্যু ও তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শারমিন বললেন, একটি দল প্রস্তুত করতে শারীরিক সক্ষমতা, যথাযথ পুষ্টিকর খাবার এবং প্রশিক্ষণ জরুরি। এসব কাজ করবে শি। ঢাকা, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট—এই পাঁচ জায়গা থেকে কিশোর–কিশোরী বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আগে অক্টোবরে কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত পথশিশুদের বিশ্বকাপে একটি সংস্থার শিশুদেরও সীমিত আকারে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল শি। 

শারমিন জানান, আবাহনীর পর্তুগিজ প্রধান কোচ মারিও লেমোস শি–র সুবিধাবঞ্চিত খেলোয়াড়দের বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

মিলছে কষ্টের ফল

যে প্রশ্নটা অনেকের মাথাতেই ঘোরে, তার জবাবে শারমিন বললেন, ‘খেলতে আসো, বললেই তো আর কেউ আসবে না। আর আমাদের তো কেউ চেনেও না। এসব মাথায় রেখেই ২০১৬ সাল থেকে এলাকাভিত্তিক তরুণ নেতা গড়ে তুলেছি। ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেলাধুলার জন্য ছেলেমেয়েদের আগ্রহী করে।’

খেলাধুলায় ছেলেমেয়েদের টানতে আরও কিছু কৌশলের আশ্রয় নেয় শি। বিনা মূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প করে। অভিভাবকেরা যখন চিকিৎসা নিতে আসেন, ছেলেমেয়েদের খেলতে পাঠানোর জন্য তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেন। এ ছাড়া কিশোর–কিশোরীদের নাশতা, খুচরা প্রতিযোগিতা করে মেডেল, ট্রফি দেওয়া হয়।

২০১৬ থেকে ২০১৯—এই চার বছরে ১ হাজার ৭৬৩ জনকে বিভিন্ন খেলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে শি। ২০২০ থেকে ২০২২—এই তিন বছরে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৩৫৭। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে শি–র ২০ খেলোয়াড়। নামীদামি অনেক স্কুলকে ডিঙিয়ে শি–র তিন কিশোর–কিশোরীর ভলিবল দল গত ২৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন গেছে। শিগগির ভারতে যাবে আরেকটি দল।

খেলাধুলার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য গত ১১ অক্টোবর শি–কে পুরস্কৃত করেছে ভারতের ‘ডক্টর বি আর আম্বেদকর স্পোর্টস ফাউন্ডেশন’। শারমিন ফারহানা চৌধুরী এখন ইন্টারন্যাশনাল ডজবল ফেডারেশনেরও সদস্য।

গৃহবধূ আর হরুইত্যারা

এই খেলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কত না অভিজ্ঞতা। একটার কথা বলতে গিয়ে তো হাসি সামলানোই দায় হয়ে উঠল শারমিনের। বললেন, শি–র হয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে শ্রীমঙ্গলে ফুটবল, হ্যান্ডবল, ডজবলের ওপর সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিন ফরাসি স্বেচ্ছাসেবী। প্রশিক্ষণের পর দুই দিনের প্রতিযোগিতাও হয়। শ্রীমঙ্গলের আশপাশের বাড়ির বউরাও উৎসাহ ভরে ফুটবল খেলেছিলেন। আর ছিল ‘হরুইত্যা’রা। সাত–আট বছরের শিশুদের হরুইত্যা বলে স্থানীয় লোকজন। ওদের জন্য প্রথমে কোনো আয়োজন ছিল না। প্রতিদিন দল বেঁধে ‘ঘ্যান ঘ্যান’ করত তারা। শেষ পর্যন্ত হরুইত্যাদের জন্যও আয়োজন রাখতে বাধ্য হয় শি। 

আছে বেদনা

বহু কষ্টে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাগেরহাটে মেয়েদের একটি রাগবি দল করেছিলেন শারমিন। তিন বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে কোভিডের আগে জাতীয় প্রতিযোগিতায় দলটি অংশও নিয়েছিল। কিন্তু কোভিডের সময় দলের বেশির ভাগ মেয়েরই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। শারমিন বললেন, ‘দলটির কথা মনে হলে বুকের ভেতরটা ছারখার করে। এ দেশে মেয়েদের খেলাধুলায় যুক্ত করা খুব কঠিন। অনেক মেয়েকেই দেখি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। মা–বাবা বকবে, এ জন্য ইচ্ছে থাকলেও খেলতে পারে না।’

চৌধুরী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও মাকসুদা চৌধুরীর দুই মেয়ের মধ্যে শারমিন ছোট। বাবা আর সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলেরি অ্যান টেইলর তাঁর কাজের প্রেরণা। সিআরপিতে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজও করেছেন শারমিন। আর এসব কাজই নিজের আয় থেকে করেন শারমিন।

শারমিন বললেন, খেলাধুলা শুধু আনন্দই দেয় না। মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তোলে। মানুষকে প্রতিবাদ করতে শেখায়। মাদকের মতো কু–অভ্যাস থেকে দূরে রাখে। সামাজিক অনেক আন্দোলনে যুক্ত করে। তাই খেলাধুলার উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের জন্য খেলাধুলাকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন। শারমিন বললেন, ‘আমি ছেলেমেয়েদের তৈরি করতে চাই, যেন তারা খেলাধুলার মাধ্যমে লাল–সবুজ পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে বিশ্বময়।’

লেখক: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক