প্রথম আলোর ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একসঙ্গে কেক কাটা
ফাইল ছবি

মন খারাপ হলে আমি দুটো কাজ করি। ১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটা পড়ি। ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।’ ২. প্রথম আলোতে অনেকটা সময় থাকি। দুটোই আমার জীবনে শক্তি জোগায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতা নিয়ে নতুন করে আর বলার কিছু নেই। জীবনের এমন কোনো বাঁক নেই, যেখানে তিনি আলো ফেলেননি। মনের বোঝাপড়ায় এমন কোনো সংকট সময় নেই, যা নিয়ে তিনি কথা বলেননি। তাই তো বারবার পড়ি, যাহার লাগি চক্ষু বুজে/ বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর/ তাহারে বাদ দিয়েও দেখি/ বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।

আর প্রথম আলো? লেখাটা যখন লিখছি, তখন অফিসে, নিজের টেবিলে। কারওয়ান বাজারের প্রগতি ভবনের ১৩ তলার ওপর থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝড়ের (সিত্রাং) পরের নীল ছাই আকাশ। দূরের ভবনগুলোতে নরম রোদ পড়েছে। নস্টালজিক হুইসেল বাজিয়ে হুস করে চলে গেল একটা ট্রেন। (এই নস্টালজিক অনুভূতির জন্মের জন্য পথের পাঁচালীর অপু–দুর্গাই বোধ হয় দায়ী।)

চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে অফিসের ভেতরে নিয়ে এলাম। সরগরম প্রথম আলো। দিনের কাজ, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রের প্রস্তুতি, গোল হয়ে আলোকচিত্রীদের সাপ্তাহিক বৈঠক, বোর্ডরুমে বিশ্বকাপের ম্যাগাজিনের বিশেষ পরিকল্পনা, ফিচার পাতা যাবে প্রেসে, একটা প্রিন্ট নিয়ে সর্বশেষ চোখ বোলানো, ‘এই শিরোনামটাই থাকবে নাকি…?’ পাশ থেকে জামিল বিন সিদ্দিকের হাঁকডাক, ‘আজকে অনলাইনে কয়টা স্টোরি গেল?’ ‘মন্তব্য ছাড়েন, মন্তব্য ছাড়েন’। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মী সম্মিলনে বিভিন্ন বিভাগের উপস্থাপনা প্রতিযোগিতার গোপন বৈঠক চলছে। এক বিভাগের সদস্যদের সঙ্গে অন্য বিভাগের আঁতাতের (ফিক্সিং) চেষ্টা, যদি কিছু ফাঁস করা যায়। এরই মধ্যে নিজের হাতে নাড়ু বানিয়ে নিয়ে এলেন একজন অতিথি, ভদ্রতা করে কিছুক্ষণ কৌটা খোলা হলো না বটে, কিন্তু খুলতেই শেষ! ডায়াবেটিক, নন–ডায়াবেটিক ভাই ভাই...। ঝুলন্ত টেলিভিশনের শব্দ কমিয়ে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূকাভিনয় ভার্সন উপভোগ, নেতৃত্বে আনিসুল হক। এক দলের আহা–উহু আফসোস! ‘মারতে গেল কেন?’ ‘ইজি ক্যাচ ছিল’। উৎপল শুভ্রর আগমন উপেক্ষা। বুকে সাহস কত? হঠাৎ পেছন থেকে গমগমে গলার আওয়াজ। লন্ডন থেকে কামাল আহমেদ এলেন সৌজন্য কুশল বিনিময় করতে। অতঃপর কিছুক্ষণ সাংবাদিকতা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। এটা শুধু একটা ভবনের প্রথম আলোর সাতটা তলার একটা তলার কিছুক্ষণের বিবরণ।

রয়ে গেল আরও ছয়টি তলার বিবরণ। পাশের সাদা ভবনের (প্রথম আলোর কর্মীরা ভালোবেসে নাম দিয়েছেন হোয়াইট হাউস) কথা তো বাদই দিলাম। সেখানে পেটের খাবার, মনের খাবার সবই আছে। ক্যানটিন থেকে প্রথমা বইয়ের দোকান। এবার আপনারাই বলেন, মন খারাপ করার সময় কোথায়?

করোনার প্রথম দিকে নিজের নিশ্বাসকে অবিশ্বাস করছিল মানুষ, তখন প্রথম আলোর কর্মীরা আক্রান্ত হওয়ার পর একজন আরেকজনের জন্য শুধু কেঁদেছেন তা–ই নয়, হাসপাতালে গিয়ে দিয়ে এসেছেন প্রয়োজনীয় ওষুধ, পথ্য, খাবার, গরম পানি ভরা ফ্লাস্ক। নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা ভাবেননি বা ভাবলেও তাকে পাশ কাটিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন সহকর্মীর বিপদ। নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছেন চিকিৎসকদের সঙ্গে।

পরিবারেও রেখেছেন যোগাযোগ। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন সম্পাদক থেকে অফিস সহকারী—সবাই। করোনা একটা বিশেষ সময়, এর বাইরেও দিনে, রাতে, গভীর রাতে প্রথম আলো পরিবারের কেউ বা তাঁর আপনজন অসুস্থ হলে, বিপদে পড়লে ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে যান অপরজন।

প্রথম আলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বড় কঠিন। দুই দিন পরপর বাক্স ভরা মিষ্টি হাতে উপস্থিত কেউ, বিনম্র লজ্জায় মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছি বা বিয়ে করেছি কুমিল্লায়…।

ইয়ে থেকে বিয়ে করেছেন দুই সহকর্মী। অফিসেই তাৎক্ষণিক হলুদের আয়োজন। কারও চিরবিদায়ে আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। সবাই আমরা নেমে যাই নিচে। বরফ দেওয়া গাড়িতে শুয়ে থাকা সরব সহকর্মীর নিথর দেহের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি সবাই। সবাই মানে সবাই। জন্ম–মৃত্যু–বিয়ে একে অপরের পাশে।

এটি এমন একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যেকোনো খবরে পাঠক এই প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকেন, প্রথম আলো কী বলছে? এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ব্যক্তিগত ভোগান্তি থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ফোন করে বলেন, ‘কিছু একটা করেন’; এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে সারাক্ষণ থাকতে হয় টানটান সজাগ। একটু পা পিছলে গেলেই শুনতে হয় ‘প্রথম আলোর কাছে এটা আশা করি না।’ অতএব সেই মৌমাছির মতো বলতে হয়, দাঁড়াবার সময় তো নাই।

মনের সঙ্গে যুদ্ধ–লড়াই কার না হয়। কিন্তু একবার অফিসে ঢুকলেই হলো। দিনের বেশির ভাগ সময় যে পরিবেশে কাটাই, যে ভাইবোনদের সঙ্গে থাকি, তারাই তো জোগায় মনের শক্তি। ২৪ বছর ধরেই। 

লেখক: ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো