আনিসুজ্জামান: ইতিহাসে লিপ্ত পথিক 

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

আনিসুজ্জামান (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭—১৪ মে ২০২০)

আনিসুজ্জামান আমাদের কালের একজন বরণীয় মানুষ। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির লোক হয়েও দেশ এবং মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগ তাঁকে আরও বিশিষ্ট করেছে। সমাজ-রাজনীতি থেকে নিজেকে সুকৌশলে দূরে রাখা নয়; বরং ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তাঁর পদচারণ অগ্রপথিকের।

কৈশোরে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং তাতে পরিচিত-অপরিচিত মানুষের বীভৎস মৃত্যু আনিসুজ্জামানকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছিল। সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা তাঁর মনে সারা জীবনের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে আনিসুজ্জামানের বাবা প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক ডা. মোয়াজ্জম সপরিবার চলে এলেন খুলনায় এবং পরের বছর ঢাকায়। এভাবে আনিসুজ্জামান বাঙালি মুসলমানের দেশভাগের রাজনীতিতে হলেন নিষ্ক্রিয় অংশীদার।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনে বাংলার মুসলমানদের ভূমিকাই ছিল অগ্রণী; যদিও শুরুতেই পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেয় অবাঙালি সামরিক-বেসামরিক আমলা চক্র। অচিরেই মোহভঙ্গ হয় পূর্ব বাংলার মানুষের। দুটি ঘটনার মধ্যে এর প্রকাশ ঘটে—১৯৪৮ সালের মার্চে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন।

আনিসুজ্জামানের দ্বিতীয় জন্ম বায়ান্নর ভাষা–আন্দোলনে। তাঁর কার্যকলাপের শুরু জগন্নাথ কলেজের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে। ৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্রধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলের দিনে তাঁর দায়িত্ব ছিল পোগোজ স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। ১১ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবসে ‘চাঁদার টিন’ নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে অর্থ সংগ্রহ করেন। ভাষা-আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে তিনিই যুবলীগের চিঠিপত্র পাঠাতেন। তবে এ সময়ে আনিসুজ্জামানের বড় কাজ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: কী ও কেন? শীর্ষক পুস্তিকা রচনা। যুবলীগের পক্ষ থেকে অনামে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই পুস্তিকাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম পুস্তিকা।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরি সভায় আনিসুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে সমাবেশের পরে শুরু হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথমে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া এবং গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই সময়ে আবারও একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় জড়িয়ে যান ১৫ বছর বয়সী আনিসুজ্জমান। মেডিকেল কলেজের ১১ নম্বর ব্যারাকের সামনে বসানো মাইক্রোফোনে মোহাম্মদ তোয়াহার বক্তৃতা লিখে লিখে দিচ্ছিলেন তিনি, একপর্যায়ে নিজেই মাতৃভাষার দোহাই দিয়ে পুলিশের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। ২ ফেব্রুয়ারি আনিসুজ্জামান তাঁর বাবার রেডক্রস চিহ্ন লাগানো গাড়িতে লক্ষ্মীবাজার থেকে মাইক লাগিয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে যান সমাবেশে যোগ দিতে। সে মাইক থেকেই দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘটের ডাক দিয়ে যে প্রচারপত্র তৈরি হয়, তার খসড়া লেখা এবং মুদ্রণের দায়িত্বেও ছিলেন আনিসুজ্জামান।

১৯৫০-এর দশকেই আওয়ামী (মুসলিম) লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান (মুসলিম) ছাত্রলীগের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সংগঠন পূর্ব বাংলার অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। এই সংগঠনগুলো স্বাধিকারের দাবির পাশাপাশি মানুষের সমানাধিকারের ধারণাতেও উজ্জীবিত ছিল। যুবলীগ (১৯৫১), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (১৯৫২), গণতন্ত্রী দল (১৯৫১)—এই তিন সংগঠনের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বলা যায়। আনিসুজ্জামান ১৫ বছর বয়সেই যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হয়েছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিলেন এবং গণতন্ত্রী দলের দলিলপত্র তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

’৬২–এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফার উত্তাল ঢেউ পার হয়ে এল ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান। ২০ জানুয়ারি আসাদের শহীদ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদ জানিয়ে মৌন মিছিল করল, আয়োজন করল শোকসভার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ১৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ হওয়ার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সভা হলো ঢাকায়, তাতে অবিরাম শিক্ষক-ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। পরে এক শিক্ষক প্রতিনিধিদল প্রাদেশিক গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে এর বিচার দাবি করেন। আনিসুজ্জামান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। তাঁর স্বভাববশতই এসব কার্যক্রমে পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আনিসুজ্জামানের ভূমিকা আরও গৌরবময়। স্বাধীনতাসংগ্রামের সশস্ত্র পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যাতে চট্টগ্রাম নগর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং এর কার্যক্রম, চাঁটগা শহরে শিল্পী-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদদের প্রতিবাদ-সংগঠন ও সমাবেশ—এসব ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করেন আনিসুজ্জামান।

মার্চের শেষে পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রাম দখল করে নিলে আনিসুজ্জামান প্রথমে ক্যাম্পাস ছাড়েন; পরে রামগড় হয়ে ২৬ এপ্রিল আগরতলা পৌঁছান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। নিজের গাড়িটা দেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে।

এরপর কলকাতা-পর্ব। সেখানে প্রথমে আনিসুজ্জামানের মূল কাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েক হাজার শরণার্থী শিক্ষককে সহায়তা ও সংগঠিত করা। পাশাপাশি শরণার্থী শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করতেও উদ্যোগী হন তিনি। কলকাতাসহ ভারতের কয়েকটি বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে কথিকায় অংশ নেন কয়েকবার। যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিজয় দিবসের বক্তৃতাসহ কয়েকটি বক্তৃতার খসড়া তাঁর। তত দিনে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ পরিকল্পনা সেলের সদস্য হয়েছেন তিনি, যাঁর কাজ দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতি ও ধ্বংসপ্রায় জীবনধারার পুনর্গঠনে পরিকল্পনা তৈরি।

এই সংক্ষিপ্ত আখ্যান থেকে স্পষ্ট যে ১৯৪৮-৭১ পর্বে বাংলাদেশের স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথে যে বাঁকবদল, তার প্রতিটিতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে এ দেশে গড়ে উঠেছিল বহুসংখ্যক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ ক্ষেত্রেও ৫০ ও ৬০-এর দশকে আনিসুজ্জামান ছিলেন সক্রিয় পুরুষ। তবে এসবের চেয়েও বড় কথা, তিনি সারা জীবন ধরে এমন চেতনা ও ভাবধারাকে ধারণ, লালন ও প্রচার করেছেন, যা বাংলাদেশ সৃষ্টির ভাবধারার সঙ্গে অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য। বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলোপ—এই চেতনাকে অন্তরে ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি, এ লক্ষ্যে প্রেরণা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও জড়িয়ে ছিলেন এর বাস্তবায়নে। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া কিংবা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুটি বাজেট প্রণয়নে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে এর পরিচয় আছে। ৬০-এর দশক থেকে যেকোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-প্রতিরোধে পথে দেখা গেছে তাঁকে; এমনকি ২০০১ সালে তীব্র শীতের মধ্যেও ছুটে গেছেন উত্তরবঙ্গে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকার প্রয়োগে তাঁর সচেতনতা অনুসরণীয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস, এর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন আনিসুজ্জামান।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। এর অস্তিত্বে ও অন্তরজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। শহীদদের স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশ। আনিসুজ্জামানও সে স্বপ্ন লালন করেছিলেন অপার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সততায়। তাঁর সেই পথচলাকে আমরা যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ: আনিসুজ্জামানের ছাত্র ও সহকর্মী; উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়