২০২১ সালের ৩১ মার্চ। দুপুরে খেয়েদেয়ে ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফেসবুকে হঠাৎ একটা খবর চোখে পড়ল। একটা ডুবে যাওয়া টাগবোটের নয়জন নাবিককে উত্তাল সাগর থেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন জেলেরা।
খবরটি যিনি শেয়ার করেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে জেলেদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে স্থানীয় এক সাংবাদিককে নিয়ে রওনা দিলাম ১৫ কিলোমিটার দূরে, সন্দ্বীপের একেবারে দক্ষিণে সারিকাইত ইউনিয়নের জেলেপাড়ায়। যেতে যেতে সন্ধ্যা। ওই জেলেদের খুঁজে বের করে বসলাম একটা চায়ের দোকানে। শুনলাম রোমাঞ্চকর সেই গল্প।
মৌসুমি বাতাসে বঙ্গোপসাগর তখন উত্তাল। ঘূর্ণি বাতাসে ঢেউ ফুঁসে উঠছে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে। তবু জীবিকা বলে কথা। মাছ ধরতে আর দশ দিনের চেয়ে একটু আগেভাগেই গভীর সমুদ্রের দিকে পাড়ি দিলেন মঙ্গল জলদাস।
সঙ্গী আরও তিনজন—চাচাতো ভাই রতপ জলদাস, শ্যালক লরকা জলদাস আর তাঁর ছেলে বিজয় জলদাস। আগে বের হওয়ার কারণ, অন্য জেলেদের কাছে মঙ্গল শুনেছেন, গভীর সমুদ্রে একটা টাগবোট ডুবেছে। এমন দুর্ঘটনা ঘটলে তেলের ব্যারেলসহ নানা জিনিস পাওয়া যায়। আগেও জাহাজডুবির পর নানা জিনিস পেয়েছেন।
নৌকা ছাড়ল দুপুর ১২টায়। ঢেউ আর বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে মাইল তিনেক যাওয়ার পর দুটি তেলের ব্যারেল পেলেন। আনন্দে সবাই উৎফুল্ল। ব্যারেলগুলো নৌকায় তোলার পর দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে মঙ্গল দেখলেন, মাইল দুয়েক দূরে হলুদ রঙের কী যেন একটা চকচক করছে। নৌকা যতই দক্ষিণে যাচ্ছে, সমুদ্র ততই গভীর। ঢেউ আরও উথাল-পাথাল হয়ে উঠছে।
নৌকা বশে থাকতে চাইছে না। কিন্তু হলুদ রং দেখে মঙ্গলের মনে খটকা লেগেছে। ঢেউ উপেক্ষা করে তাঁরা দ্রুত নৌকা চালালেন। কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন জলজ্যান্ত নয়জন মানুষ সাগরে ভাসছে। গায়ে লাইফ জ্যাকেট বলে কেউ ডুবে যায়নি। একজন আরেকজনের সঙ্গে বাঁধা। মঙ্গল আর তাঁর সঙ্গীরা একে একে তাঁদের নৌকায় তুলে নিলেন।
নৌকা ছোট। চারজনের বেশি মানুষ তোলার জায়গাও তেমন নেই। তীব্র ঢেউয়ে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু মঙ্গল আর তাঁর সঙ্গীরা তার মোটেই তোয়াক্কা করলেন না। মৃত্যুর মুখে কাউকে ফেলে আসা যায়?
উত্তেজনার বশে সে রাতেই মঙ্গল জলদাসদের মুখে শোনা গল্পটা ফেসবুকে লিখে ফেলি। মঙ্গল জলদাস ও তাঁর সঙ্গীরা মানুষের প্রশংসা আর ভালোবাসায় ভেসে যেতে থাকেন।