জুডিশিয়াল স্টেটসম্যানশিপের খোঁজে
প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস (গরিমা ও কুসংস্কার) একটি প্রবাদপ্রতিম ইংরেজি শব্দজোড়। ব্যক্তির জীবনে যেমন প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের উপস্থিতি রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রের চলন-ইতিহাসেও। রাষ্ট্রের ব্যক্তিত্ব নির্মাণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এই প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস নির্মিতিতে বিচার বিভাগের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আমাদের পাঁচ দশকের বেশি রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রাইড (গরিমা) যেন তেপান্তরে থাকা কোনো প্রত্যয়। এর পরিবর্তে রাষ্ট্রযন্ত্রে যেন প্রেজুডিসের অবারিত উপস্থিতি। এখন প্রেজুডিস (কুসংস্কার) দূর করতে সংস্কারের আওয়াজ উঠেছে। তবে জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থান এর নিকটতম প্রভাবক হলেও এর প্রয়োজনীয়তা যে মাত্রই অনুভূত হচ্ছে, এমন নয়।
আইনসভা বা জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে সংবিধিবদ্ধ সংস্থার জন্য। আইনের প্রতিপালনে নির্বাহী বিভাগের সীমাবহির্ভূত (আইনি) কাজের প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্র বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রের সংসদ, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একই গ্রন্থিতে অবস্থান করে। কারেকটিভ (সংশোধনমূলক) এবং প্রয়োজনে রিফরমেটিভ (সংস্কারমূলক) পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ করে বিচার বিভাগ। বাকি দুই বিভাগের নানা ব্যত্যয় ন্যায্যতার স্বার্থে চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগ। তাই অন্য দুই বিভাগের চেয়ে বিচার বিভাগের শক্তিসামর্থ্য আর সংস্কার অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সংস্কারের সর্বাত্মক সম্মতির পেছনের কারণ ও ব্যাকরণ কী, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দীর্ঘকাল আইনহীনতার দূষিত ইকোসিস্টেম (পরিবেশ–ব্যবস্থা) ছিল সর্বত্র। আইনের শাসন ছিল না কোথাও, ছিল শাসনের জন্য অগণন আইন। কিন্তু আইন যদি যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে না পারে, তাতে কী হয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ তো আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি।
পোয়েটিক জাস্টিসের (কাব্যিক ন্যায়বিচার) এক ফলিত রূপায়ণ যেন বর্তমান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ। সাধারণত জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণীয় বিচারপতিদের আপিল বিভাগে উত্তরণের প্রশ্নে। বিচারিক সক্ষমতা বা বিদ্যায়তনিক উৎকর্ষ যেন কোনো মানদণ্ড নয়। কিন্তু সেই জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করলেও বর্তমান প্রধান বিচারপতির এই দায়িত্ব পাওয়ার কথা বর্তমান সময়ে। আর তাঁর বিদ্যায়তনিক অর্জন বিশ্বমানের, আমাদের দেশের বিবেচনায় প্রায় তুলনাতীত। অভূতপূর্ব এক রাজনৈতিক পালাবদল এই পোয়েটিক জাস্টিসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
‘দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস ইজ দ্য ফার্মেস্ট পিলার অব গভর্নমেন্ট’ (বিচারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ), জর্জ ওয়াশিংটনের এই চিন্তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার যুক্তি না আইন বিভাগের, না নির্বাহী বিভাগের আছে। কারণ, আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনের ন্যায্যতা ও প্রশাসনিক আদেশের যথার্থতার যাচাই বিচার বিভাগের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব। এখানে জাস্টিস (বিচার) কেবল ধারণাগত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস’ শব্দবন্ধে ন্যায়বিচারের প্রায়োগিক দিক নির্দেশ করছে। ড. ইউনূস এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের সমান্তরালে বিচার বিভাগের সংস্কারের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে বিচারকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, এমন বিষয়ও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, যা নজিরবিহীন। মনে থাকার কথা, হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস লিখছিলেন প্রথম আলোয়, একপর্যায়ে আদালত কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে উপন্যাসের ন্যারেটিভ বদলে ফেলতে হয়েছিল। ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিষয় মীমাংসার জন্য আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগের নজির কি আছে কোথাও পৃথিবীতে? এটা পরিহার্য।
আমাদের রাষ্ট্রের কোনো বিভাগ নিয়ে গর্ব তো দূরের কথা, অন্য দেশের সাপেক্ষে আলোচনাও করা যায় না। বছর বছর যে ন্যায়বিচার সূচক প্রকাশিত হয়, তাতে বাংলাদেশের নিচের সারিতে অবস্থানই এর প্রমাণ। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এমনই প্রশ্নের মুখে যে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের খড়গে পড়ার আশঙ্কাও পেয়ে বসেছিল।
নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের রয়েছে এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব। নানা ঘটনায় এর প্রকাশ দেখা যায়। মোবাইল কোর্ট–সংক্রান্ত রিটে ২০১৭ সালের হাইকোর্টে দেওয়া রায় স্থগিত রয়েছে। আপিল বিভাগে বিচারাধীন এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে বিচার বিভাগের অস্বস্তি দূর করা প্রয়োজন। তাহলে বিচার বিভাগের প্রকৃত গরিমা ফিরে পেতে পারে।
কোম্পানি ও অ্যাডমিরাল্টি ছাড়া মোটাদাগে উচ্চ আদালত নয়, জেলা আদালতই বিচারিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিভূমি। কিন্তু জেলা আদালত চিরন্তন উদাসীনতার শিকার। একেবারে নামাবলি থেকেই শুরু। ‘নিম্ন আদালত’ পরিচয়টিতেই এক অস্বস্তিকর অবজ্ঞা নিহিত। অধস্তন আদালতের বিচারক একধরনের মিসনোমার (ভুল নাম), যা বিচারসত্তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো বিচারকই অন্য কোনো বিচারকের অধস্তন নন। বিচারিক কাজে সর্বস্তরের বিচারকই স্বাধীন। তাই স্বাধীন বিচারসত্তার স্বার্থে জেলা পর্যায়ের বিচারক দেওয়া দরকার অন্য কোনো সম্মানজনক অভিধা। রাজনৈতিক সরকারগুলো একই প্রিজমে দেখে বিচার বিভাগকে। তারা ভাবে, জেলা জজ আদালতের বিচারকেরা অপরাপর ক্যাডারের কর্মকর্তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নন, সংস্কার এখানেও প্রয়োজন।
এত দিন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপিল বিভাগে উত্তরণ রাজনৈতিক পছন্দ–অপছন্দে দৃষ্টিকটুভাবে প্রভাবিত হয়ে আসছিল। নিয়োগে কলেজিয়াম বা অন্য কোনো কার্যকর উপায় অনুসন্ধান সংস্কার কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব।
বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র বাজেট অথবা পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও বিচারকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। বেতনবৈষম্য দূর করে প্রায় ৪২ লাখ মামলার ভার লাঘবে যথেষ্ট সংখ্যায় বিচারক নিয়োগ প্রত্যাশিত।
বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকেরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা তত দিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যত দিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটিই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।’ তাঁর হাত দিয়ে যদি প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তাঁর পিতা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের নেওয়া এই স্বপ্ন-প্রকল্পের রূপায়ণের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক সমাপতন দেখতে পাবে জাতি। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন মাসদার হোসেন মামলার আইনজীবী, বিনা পারিশ্রমিকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি লড়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেছেন, এই প্ল্যান অব অ্যাকশনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতকরণে ‘ইউএন বেসিক প্রিন্সিপলস অন দ্য ইনডিপেনডেন্স অব দ্য জুডিশিয়ারি’ বর্ণিত বিধানকে অনুসরণীয় সেরা আচরণীয় নির্দেশিকা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
প্রধান বিচারপতির অভিভাষণের পর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়টি প্রণিধানযোগ্য। রাজনৈতিক সরকারের জন্য বিচার বিভাগের সংস্কারকাজ বকেয়া রাখা ঠিক হবে না। অন্তত বিচারক নিয়োগ ও আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজটি অন্তর্বর্তী সরকারই করে যেতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসলে একটি পলিটিকো-লিগ্যাল সর্বজনীন প্রত্যয়, অথচ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই তা নিশ্চিত করতে অনীহা দেখিয়েছে। আংশিক হলেও মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়ন করতে হয়েছে অরাজনৈতিক এক–এগারো সরকারকে। আরেক দফা সুযোগ এসেছে প্রকৃত সংস্কার করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে।
বর্তমান সময়ে আগের কর্তৃত্ববাদী শাসকের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শিক কাঠামোর অনুপস্থিতিতেও যদি কোনো সংস্কার সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে এই অভ্যুত্থান শাসক পরিবর্তন বৈ অন্য কিছু হবে না। সংস্কারবিহীন ভবিষ্যৎ বস্তুত সেই আইনহীন কিংবা অতি আইনের পুরোনো কাঠামোরই পুনরুৎপাদন। আর যাঁর হাতে বিচার বিভাগের সংস্কার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, তিনিই হবেন সেই জুডিশিয়াল স্টেটসম্যান।
*এম এম খালেকুজ্জামান: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী; দ্য কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ সার্চ ফর আ জাস্ট সোসাইটি বইয়ের অন্যতম সম্পাদক