বেদনাদায়ক হলেও সত্যি

প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এই আয়োজন।

‘আমি চেষ্টা করেছিলাম বাইক আরোহীদের হেলমেট পরাতে। শুধু পুলিশ ধরে-বেঁধে আইন মানাতে পারবে না। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সব স্তরে সড়ক আইন মেনে চলা ও হেলমেটের ব্যবহারের চর্চা করতে হবে। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিও সমান জরুরি’—ছবিটি দেখে এমন মন্তব্য করেছিলেন পাবনার সাবেক পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান। পাবনা থাকাকালীন সময়ে মোটরবাইকের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে বেশ কঠোর ভূমিকা ছিল তাঁর। এখনো বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকদের কথা উঠতে এখনো উঠে আসে তাঁর কথা।

এবার তবে মূল গল্পে আসি। ঘটনাটি সেই ছবি ছাপা হওয়ার ২৫ দিন পরের। গত ৩১ মে, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় মোটরবাইক নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন সেই সুজন মণ্ডল। মাঝপথে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলির (স্থানীয় নাম কুত্তাগাড়ি) সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার মাঝপাড়া ইউনিয়নের দুর্গাপুর মজিবর মোড় এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় দুর্ঘটনায় ভাঙাচোরা মোটরসাইকেল ও আটক করা হয় ট্রলি গাড়িটি।  

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার মাঝপাড়া ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের ফরহাদ মণ্ডলের ছেলে সুজন মণ্ডল পেশায় একজন টিন মিস্ত্রি ছিলেন। ভালো কাজের জন্য মাঝপাড়া এবং মুলাডুলি ইউনিয়নের মানুষের কাছে তার বেশ সুনাম ও পরিচিতি ছিল। তিনি বিভিন্ন বাড়িঘর ও দোকানের টিনের কাজ করতেন। কাজের পাশাপাশি তিনি ঘুরতেও ভালোবাসতেন। নিজের কোনো মোটরসাইকেল না থাকায় অন্যের মোটরসাইকেল ধার করে ঘুরতেন। তবে হেলমেট ব্যবহারে অনেকের মতো তারও উদাসীনতা ছিল। সেদিনের দুর্ঘটনার মোটরসাইকেলটিও ছিল ধার করা। যথারীতি মাথায় ছিল না কোনো হেলমেট। দুর্ঘটনায় সংঘর্ষের সময় ট্রলি গাড়িটির হেডলাইটের পাতে লেগে তাঁর মাথা গুরুতর জখম হওয়ায় তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।  

তাঁর প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ পড়েন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগে। তিনি দীর্ঘ ১০ বছরের ওপরে প্রথম আলোর পাঠক। তাই প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া ছবিটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাঁর মাধ্যমেই জানা যায় ঘটনাটি। তিনি বলেন, ‘ছবিটি যখন প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল, তখন সুজন মামাকে দেখেই চিনতে পারি। সেদিনই পত্রিকাটা তাঁকে দেখিয়ে সচেতন হওয়ার কথা বলেছিলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ছবি ছাপা হওয়ার এক মাস যেতে না যেতে সেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাতেই মামা মারা গেলেন। আজ যদি তাঁর হেলমেট পরা থাকত, তবুও হয়তো এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যেতেন তিনি।’

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে আটঘরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনও জানিয়েছিলেন, হেলমেট না থাকায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে সুজন মণ্ডলের মৃত্যু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে  লাশ তাঁদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সুজন মণ্ডলের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুগুলো আমাদের মন ভারী করে দেয়। সুজন মণ্ডলের মতো দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে পরিবারের স্বজনদের স্বপ্ন ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। সারা জীবনের কান্না হয়ে তা বয়ে বেড়াতে হয়। কিন্তু তবুও মানুষকে পথ চলতে হয়। মানুষের পথ চলা যত দিন থাকবে দুর্ঘটনাও হয়তো তত দিন থাকবে। তাই সচেতন হতে হবে চালক, যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ সবাইকে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যক্রম জোরদার করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাই মিলে। তবেই এ নিঃশব্দ ঘাতকের রোধ করা সম্ভব।

হাসান মাহমুদ,
চিত্র সাংবাদিক,
প্রথম আলো