বাধা ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন তসলিমা

মনের জোর থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তসলিমা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ছবি: প্রথম আলো

বিয়ের পর তসলিমা রহমানের জীবনযাপন সাধারণ গৃহবধূর মতোই ছিল। সংসারের কাজকর্ম আর সন্তানদের পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছু ভাবতে হতো না তাঁকে। পরপর তিন মেয়ের পর এক ছেলে তাঁর। ছেলেটি যখন কোলের শিশু, ঠিক তখন সব ওলটপালট হয়ে যায়। স্বামী সাংবাদিক আতিকুর রহমান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শহরের পত্রিকার এজেন্ট ও সাংবাদিক স্বামীর মৃত্যুতে তসলিমার জীবনে ছন্দপতন ঘটে। প্রায় থমকে যায় জীবন।

একদিকে পরিবহনের ব্যবসা, অন্যদিকে জেলা শহরের একমাত্র পত্রিকার এজেন্ট। দুটো ব্যবসা নিয়ে ঝামেলায় পড়েন তসলিমা। কিন্তু তিনি দমে যাননি। সাহস করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি দুটো ব্যবসা পরিচালনায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। যেকোনো পেশায় নারীরা যে পিছিয়ে নেই, এখন তিনি তার উদাহরণ।

মেহেরপুর পৌর শহরের বাসিন্দা সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান টিটু প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। পত্রিকা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভোগার পর তিনি ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর মারা যান।

মেহেরপুর পেপার হাউসের ব্যবস্থাপক লাল্টু মিয়া জানান, ২০১৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সাংবাদিক আতিকুর রহমান মারা যাওয়ার পর পরিবারে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নানান ঝামেলা তৈরি হয়। তসলিমা তখন সংসারের কাজকর্মের বাইরে এসব ব্যবসা নিয়ে কিছু বুঝতেন না। তবে ঝামেলা মিটিয়ে তিনি সংসারের পাশাপাশি ব্যবসায় মনোযোগ দিতে শুরু করেন। নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে বসে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি সফল হন। তসলিমা এখন পৌর শহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত।

তসলিমার ভাই সাংবাদিক ফারুখ হোসেন বলেন, তসলিমার জীবন ছিল ঘরের ভেতর। মেয়েদের লেখাপড়া ও সংসার গোছানো ছিল একমাত্র কাজ। স্বামীর অকালমৃত্যু তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। তিনি এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।

সম্প্রতি তসলিমার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পেপার হাউসে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি তখন ব্যবসার হিসাব-নিকাশ নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলেন। কাজ রেখে তিনি তাঁর থমকে যাওয়া জীবনের গল্প শোনাতে শুরু করেন। বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে যেন অথই সাগরে ভাসছিলেন। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।

একপর্যায়ে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করলেন, সংসারের পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসাও চালিয়ে নেবেন। নানান বাধা, আপত্তি, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অদম্য মনোবল, সততা আর একাগ্রতা তাঁকে আজ সফলতার মুখ দেখিয়েছে।

আতিকুরের মৃত্যুর পর আরও কয়েকজন একই ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে পত্রিকা নিয়ে মেহেরপুরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে দিতে শুরু করেন। তাঁরা নতুন নতুন হকার নিয়োগ করেন। তসলিমা এসব সমস্যা পার করেন শক্ত হাতে ব্যবসা পরিচালনা করতে। কিন্তু করোনার ভয়ে মানুষ বাড়িতে, অফিসে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দিলে মারাত্মক সংকটে পড়েন তিনি। তবে সব সমস্যা কাটিয়ে এখন পত্রিকার ব্যবসা আগের মতো না হলেও একটা ভালো অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

তসলিমা বলেন, ‘অনেকে মনে করেছিল আতিকুরের মৃত্যুর পর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। একজন নারী কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য
সামলাবেন। আমি এসব কথায় দমে যাইনি। শুধু মনের জোরে ব্যবসার হাল ধরেছি। ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি।’ সব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে এই সমাজে নারীদের এগিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। তবে মনের জোর থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তসলিমা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।