তরুণদের পথ দেখাচ্ছেন সুবীর

আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের কর্মশালায় সুবীর নকরেক

২০১৬ সালে ঢাকায় ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ বিষয়ে একটা কর্মশালা করেছিলেন সুবীর নকরেক। সেই প্রথম আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ সম্পর্কে ধারণা পান মধুপুরের এই গারো তরুণ। আস্তে আস্তে নিজের চেষ্টায় গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়ার্ডপ্রেস ও ডিজিটাল বিপণনে দক্ষ হয়ে ওঠেন। কর্মস্থল হিসেবে বেছে নেন মধুপুর বনাঞ্চলের নিজ গ্রাম গায়রা। গ্রামের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের ফ্রিল্যান্সিং বোঝাতে থাকেন। কোন কাজ কীভাবে করলে অর্থ আয় করা যায়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেসব সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করেন। আশপাশের গ্রামগুলোয় গিয়েও বিনা মূল্যে সেমিনার ও সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেন। কেউ বুঝলেন, কেউ আবার হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না সুবীর নকরেক। শেষমেশ অনেক তরুণ আগ্রহী হলেন, শিখলেন নানা রকমের কাজ। গায়রা ও আশপাশের গ্রামে এখন ৩৫০ জন ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। পাশাপাশি নিজেও ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে যাচ্ছেন সুবীর নকরেক। প্রথম দেড় বছরে তাঁর আয় হলো ১১ হাজার মার্কিন ডলারের মতো।

কাজগুলোকে আরও সংগঠিতভাবে করার জন্য ২০১৭ সালে  সুবীর প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট’। কিন্তু ইন্টারনেটের ধীরগতি আর সংযোগ না পাওয়ায় গায়রা থেকে কাজ চালানো দুরূহ হয়ে পড়ল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাই নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের শাখা চালু করেন তিনি। এ প্রতিষ্ঠানের এখন চারটি শাখা—ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলি, গাজীপুরের ফুলবাড়িয়া, জামালপুরের নান্দিনা এবং ঢাকার বসুন্ধরা। এগুলোয় কাজ করছেন ৪৫ জন কর্মী। দেশের বিভিন্ন স্থানে সেমিনার করেছে এ প্রতিষ্ঠান। সেমিনারের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ধারণা পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার তরুণ–তরুণী।

ছয় বছরের মধ্যেই সুবীর নকরেক এখন এক সফল ফ্রিল্যান্সার। গায়রা থেকে দেশ-বিদেশের বহু গ্রাহকের হয়ে আউটসোর্সিং করে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে পিছিয়ে পড়া থাকা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা কাজ শিখিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট থেকে এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১০ হাজার তরুণ–তরুণী। তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। প্রশিক্ষণ নেওয়া গারো তরুণই আছেন ছয় হাজার। আছেন চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বর্মণ, কোচ, ওঁরাও, ত্রিপুরা, পাংখো, রাখাইন, খাসিয়া, হাজং, বম ও ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষ।

সুবীর নকরেক বলেন, ‘যে জায়গাগুলোয় প্রশিক্ষণ দিই, সেগুলোর বেশির ভাগই প্রত্যন্ত গ্রাম। ফ্রিল্যান্সিং শেখার আগ্রহ থাকলেও এসব গ্রামের অনেকেরই প্রশিক্ষণ কোর্স করার জন্য প্রয়োজনীয় এক-দুই হাজার টাকাও নেই। কিংবা দেওয়াটা কষ্টকর তাদের পক্ষে। তবু যতটুকু দিতে পারে, তা নিয়েই আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিই।’

অর্জন যত

‘বনে বসে সুবীরের ডলার আয়’ শিরোনামে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় সংবাদ প্রকাশের পর সেখানে উচ্চগতির ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়ে যায় ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান আম্বার আইটি ও মুঠোফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রীও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। মধুপুরের গায়রা গ্রামে নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের জন্য ১০০ শতাংশ জমি দিয়েছেন সুবীরের মা–বাবা। এখানেই স্থাপন করা হবে নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট। এখান থেকেই আশপাশের ৫০টি গ্রামের তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে চান সুবীর।

নকরেক আইটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন দিনা মৃ। এই গারো তরুণী বলেন, ‘২০১৯ সালে নার্সিং ছেড়ে নকরেক আইটিতে মাস্টারিং অন ডিজিটাল মার্কেটিং উইথ ফ্রিল্যান্সিংয়ের চার মাসের কোর্স করি। কোর্স শেষ করার চার দিন পরই কাজ পাই।’ দিনা মৃ এখন একজন ডিজিটাল মার্কেটার। ২০ জনের দল নিয়ে কাজ করেন। এর মধ্যেই পাঁচ শতাধিক কাজ করে ফেলেছেন।

২০১৭ সালে নকরেক ইনস্টিটিউটে কোর্স করেন জেস মৃ। বলেন, ‘আমি এখন অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ তৈরির কাজ করি।’ নকরেক থেকে কোর্স করা হিমালয় নকরেক এখন গ্রাফিক ডিজাইন করেন। ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন গারো সম্প্রদায়ের ফ্রিল্যান্সার তৃষ্ণা দিও। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দিতে তাঁর বাড়ি। সেখানে বসেই এখন দেশ-বিদেশের কাজ করে যাচ্ছেন তৃষ্ণা।

আইটির মাধ্যমে এভাবে ২০টি জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ করে তুলেছেন সুবীর নকরেক। গত ১৯ অক্টোবর ময়মনসিংহে কার্যালয়ে বসে নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়া তরুণ-তরুণীর মধ্যে ১ হাজার ২০০ জন এখন স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজারে কাজ করছেন। নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে শুধু নিজেকেই এগিয়ে নিচ্ছেন না, নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর তরুণদেরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সুবীর নকরেক।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিক ও লেখক