পঁচিশের নির্বাচিত সাক্ষাৎ​কার: শিনজো আবে

দুই দেশের বন্ধন পতাকা আর ধানে

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে প্রথম আলোপ্রথম আলোর জন্য তাঁরা লিখেছেন বিশেষ শীর্ষ রচনা, দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেসবের নির্বাচিত একটি অংশ রইল এখানে।

শিনজো আবে

পতাকা আর ধান—এ দুটি বিষয়ে সাযুজ্য রয়েছে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে। এই মিলগুলোকে দুই দেশের জনগণের আত্মিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে দেখেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তাঁর ঢাকা সফরে এই বন্ধন আরও জোরদার হবে। 

২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে দুই দিনের বাংলাদেশ সফরের ঠিক আগে প্রথম আলোকে ই-মেইলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ আশাবাদের কথা জানান। 

২০০০ সালে ঢাকা সফর করেছিলেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মরি। দীর্ঘ বিরতির পর এবারের সফরের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিনজো আবে দুই দেশের ‘সমন্বিত অংশীদারত্ব’কে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ করার আশা প্রকাশ করেন। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গত ১৪ বছরের মধ্যে আপনিই হচ্ছেন বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম জাপানি প্রধানমন্ত্রী। ঐতিহাসিক এই সফর থেকে কী ফল আশা করছেন? বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে
আপনি অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

 শিনজো আবে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত মে মাসের জাপান সফরের চার মাস পর গত ১৪ বছরের মধ্যে জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি বাংলাদেশ সফর করতে যাচ্ছি। জাপান ও বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে গভীর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে ২০১৪ ব্যাপক অগ্রগতির ক্ষেত্রে উভয় দেশের জন্যই একটি বিশেষ বছর। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান প্রধান সহযোগী দেশ হিসেবে সহযোগিতা দেওয়ায় আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। 

দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) উদ্যোগ-এর আওতায় জাপান বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক অবকাঠামো, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আগামী চার-পাঁচ বছরে সর্বাধিক ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ১২০ বিলিয়ন ইয়েন জাপান ‘ইয়েন লোন’ হিসেবে বরাদ্দ দিয়েছে। জাপান নিয়মিতভাবে এই সহযোগিতা বাস্তবায়ন করে যাবে। 

স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশকে ‘নেক্সট ১১’–এর অন্যতম দেশ বলা হচ্ছে। আর ‘আবেনোমিক্স’-এর মাধ্যমে পুনর্জাগরিত হচ্ছে জাপানের অর্থনীতি। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের লক্ষ্য, দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হয়—এমন একটি পারস্পরিক সম্পর্কের লক্ষ্যে কাজ করা। 

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে যত বেশি সম্ভব জাপানি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করা বাঞ্ছনীয়। সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। 

আমি আশা করব, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রথম জাপান-বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি
পর্যায়ের যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপের মতো উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নয়নে আরও সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নেবে। 

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে একনজরে দুটি সাদৃশ্য বিদ্যমান। প্রথমত, আমাদের জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার বছর আগে এবং এ বছরও জাপান সফরের সময় বিষয়টি তুলে ধরে দুই দেশের সম্পর্ককে সহোদরতুল্য হিসেবে উল্লেখ করেন। 

অন্যটি হলো বিস্তীর্ণ ধানখেতের প্রাচুর্য। বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে পরিচিত। আর জাপানকে বলা হয় ‘ধানের দেশ’। এই সাদৃশ্যগুলো দুই দেশের মানুষের আত্মিক সৌহার্দ্যের প্রতীক বলে আমি মনে করি। আশা করি, আমার এবারের সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে।

আমি এ সুযোগে বলতে চাই, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বিত অংশীদারির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা বিশ্বে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা চলছে। আপনি কীভাবে এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন এবং বিশ্ব শান্তির জন্য জাপান কী ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে পরিকল্পনা করছেন?

 শিনজো আবে: যেকোনো সংঘাতই জোরপূর্বক নয়, বরং শান্তিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা উচিত। জাপান বারবার আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। 

আমি মনে করি, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, আফ্রিকাসহ যেসব জায়গায় ইতিমধ্যে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানে সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিক সমাধান হওয়া উচিত।

জাপান যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই উন্নয়ন সহযোগিতা ও শান্তি রক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রেখে চলেছে। এসবই করা হচ্ছে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রাখার উদ্দেশ্যে। 

বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক অস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অপতৎপরতার হুমকি বেড়েই চলেছে। এর ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনো দেশেরই একার পক্ষে সম্ভব নয়। 

জাপান শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে এর ঐতিহ্য বজায় রাখবে এবং ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট’ অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে
অবদান রাখবে। 

শিনজো আবে: জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী 

প্রথম আলোর শীর্ষ খবর, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪