আগুনে পোড়া হৃদয়

প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা প্রকাশ করছি দেশে–বিদেশে থাকা আমাদের পাঠকের লেখা। তাঁরা লিখেছেন তাঁদের নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্য অভিজ্ঞতার গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা।     লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

দুপুরবেলা সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরিয়ে এসেছি রাস্তায়। রওনা দিয়েছি একটু দূরের পাকা মার্কেটের দিকে। কিছু ওষুধ কেনা দরকার।

রাস্তায় নামার ঠিক আগের মুহূর্তে দেখি, গেট থেকে সামান্য দূরে এক জোড়া ছেলেমেয়ে ঝগড়া করছে। ফুটপাতের পাশে সম্ভবত ওদেরই একটা হলুদ রঙের স্কুটি। ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম, ঝগড়া করছে আসলে ছেলেটিই। বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে সে। রাস্তা পার হতে হতে অস্পষ্টভাবে যতটুকু কথা কানে এল, তাতে মনে হলো, মেয়েটির কোনো একটা কিছু তার পছন্দ হয়নি।

অনুমান করলাম, অন্য কারও সঙ্গে মেয়েটির কোনো রকমের যোগাযোগ নিয়ে সে তর্জন করছে মেয়েটিকে। মেয়েটি শান্তই দেখা গেল। অনেকটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে সে। ওদের কীর্তিকলাপ দেখে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারবোধের ভবিষ্যৎ নিয়ে দার্শনিক চিন্তা করতে করতে রাস্তা পার হয়ে পাকা মার্কেটের পথ ধরলাম।

ওষুধ কিনতে যে খুব বেশি সময় লাগল তা নয়। মিনিট পাঁচ–ছয়েকের মধ্যেই ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখি, এখনো তারা ওই একই জায়গাতেই আছে। তবে এবার মেয়েটিও সরব হয়েছে। উভয় পক্ষই সমান উৎসাহে বাগ্‌যুদ্ধে মেতেছে। হাত নেড়ে নেড়ে এখন উত্তেজিত গলায় কথা বলছে মেয়েটি। মানবজাতির চিরন্তন দ্বৈরথের কথা ভেবে করুণামাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাস্তা পেরিয়ে গেটে পা রাখলাম।

তক্ষুনি মেয়েটির তীব্র চিৎকার কানে এল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, এতক্ষণ ঝগড়া করতে থাকা যুবকটি ফুটপাতে শুয়ে বেখাপ্পা ভঙ্গিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর মেয়েটি চিৎকার করে তার চারপাশে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করছে। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে বলে মনে হলো। ঘটনাস্থলের দিকে আমি দৌড়ে গেলাম।

মুহূর্তের মধ্যে আশপাশ থেকে লোক জড়ো হয়ে জটলা বেঁধে গেছে। কাছে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে গা শিউরে উঠল। যুবকটার শার্টের পেছনের দিক একেবারে পোড়া। শার্টের পোড়া ফোকরটার ভেতর থেকে তার পুড়ে সাদা হয়ে যাওয়া পিঠ দেখা যাচ্ছে। এবার বুঝলাম, গায়ে সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। গায়ে আগুন লেগে যাওয়ার পর সেটা নেভাতে সে ফুটপাতের শেওলাধরা দেয়াল ঘেঁষে নিচে জন্মানো আগাছায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কী করবে বুঝতে না পেরে হতবাক মেয়েটি এগিয়ে গিয়ে যুবকটিকে ধরার চেষ্টা করছে। যুবকটি গড়াগড়ি খেতে খেতে বলছে, ‘ডোন্ট টাচ মি।’

রাস্তাটা পার হয়ে যেতে আমার যে পাঁচ–ছয় সেকেন্ড সময় লেগেছে, সেটুকুর মধ্যেই ছেলেটা লাইটার বের করে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসার সেই যন্ত্রণাময় দৃশ্য দেখতে দেখতে মোগল আমলে দিল্লির এক কবির শায়েরি মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছিলেন, ‘মানুষ বানাতে গিয়ে পঞ্চভূতের মাটি, জল, বায়ু সব খরচ করে ফেলার পর অবশিষ্ট যে আগুন ছিল; তা–ই দিয়েই ঈশ্বর বানিয়েছেন প্রেমিকের হৃদয়।’ এই যুবকটিকেও মনে হলো তেমনই আগুনে গড়ে তোলা এক প্রেমিক।

এক সহৃদয় লোক রিকশায় করে ছেলেটিকে দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অসহায় মেয়েটি কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে, আর যুবকটি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো তখনো বলে চলেছে, ‘ডোন্ট টাচ মি, ডোন্ট টাচ মি।’

মেয়েটি থমথমে মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর তার স্কুটিতে চড়ে যুবকটিকে বহন করা রিকশার পিছু নিল। যন্ত্রণাকাতর দগ্ধ প্রেমিকের পিছু পিছু ছুটে চলেছে তার হতবিহ্বল প্রেমিকা। এক অদ্ভুত বিরল দৃশ্য।

হলে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, এই আগুনে প্রেম তাদের কত দূর নিয়ে যাবে? পরক্ষণেই মনে হলো, থাক না, আপাতত না হয় হাসপাতাল পর্যন্তই যাক।