কেমন করছে প্রথম আলো

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যেকোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য একটি মাইলফলক। প্রথম আলোর জন্য এটি শুধু টিকে থাকার নয়, দাপটের সঙ্গে থাকারও মাইলফলক। সংবাদপত্রের সাফল্য নির্ণীত হয় সাধারণত তিনটি বিচারে—জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও বাণিজ্যিক সাফল্য। তিনটি বিচারেই প্রথম আলো দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক এবং সেটি তার প্রায় সূচনার অল্প সময় পর থেকে আজকের ২২ বছর পূর্তির দিন পর্যন্ত।

প্রথম আলো কি তাই বলে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ? এর কি উন্নতির জায়গা আর নেই, তাগিদটা কি শুধু ধরে রাখার? আমার মনে হয় না তা। ভাষা ও পরিবেশনের ভঙ্গি হোক, বিষয়বস্তু বৈচিত্র্য হোক, অনুসন্ধানের গভীরতায় হোক, প্রথম আলো নিজেকে বিনির্মাণের চেষ্টা করে যায়। কিন্তু একজন পাঠকের দৃষ্টিতে তারপরও এখানে অতৃপ্তির জায়গা থাকতে পারে, আরও প্রত্যাশা থাকতে পারে।

আমার নিজের পক্ষে অবশ্য শুধু পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম আলোকে বিচার করা কঠিন। কারণ, বহু বছর ধরে আমি নিয়মিত লিখি এখানে, এখানকার অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং এসব কারণে আমার পাঠকসত্তা প্রভাবিত।

আমার স্ত্রী শীলা আহমেদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার কথা নয়। সে একটি বড় দূতাবাসে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। সে নিজেও প্রথম আলোর আজন্ম পাঠক। তার সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা আমাকে বহুবার মুগ্ধ করেছে। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এর শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি তাই তার সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখি, তার প্রায় সব বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। আগে তার কথাগুলো বলি, পরে আমার ব্যাখ্যা দেব।

২.

শীলাকে বলি, প্রথম আলো পড়ো কেন? সে প্রথম যেটা বলল, তা হচ্ছে প্রথম আলোর বিশ্বাসযোগ্যতা। যেকোনো সংবাদ অন্য পত্রিকায় দেখলে সে তা পুরোপুরি বিশ্বাস করে না যতক্ষণ না পর্যন্ত তা প্রথম আলোয় ছাপানো হয়। এ নিয়ে তার অনুযোগও আছে। প্রথম আলো কিছু ক্ষেত্রে সংবাদটা ছাপাতে বেশি সময় নেয়। আমি বললাম, সেটা হয়তো নিশ্চিত হওয়ার জন্য। কোনো সংবাদের সত্যমিথ্যা যাচাই করতে কিছুটা সময় লাগে।

প্রথম আলোকে পছন্দ করার শীলার দ্বিতীয় কারণ, এখানে গসিপ ও অশ্লীল খবর ছাপা হয় না। তার ভাষায়, পত্রিকা হাতে নিয়ে মনে হয় না পৃষ্ঠা–পাতা ওলটালে আমি বা আমার সন্তানেরা বিব্রত হব—এমন কিছু থাকবে।

শীলা বেশি পছন্দ করে প্রথম আলোর দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসজ্জা। পত্রিকার ফন্ট, মেকআপ, গেটআপ কয়েক বছর পরপর পরিবর্তন করা হয়। তার ভাষায়, সব সময় তা খুব ভালো হয় না। কিন্তু একঘেয়েমি কাটানোর এ চেষ্টা, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা খুব ভালো লাগে।

শীলার কিছু অভিযোগের কথা প্রথমে বলেছি। এ ছাড়া, তার মতে প্রথম আলো সরকারের সমালোচনা করার সময় ব্যালান্স করার চেষ্টা করে। ন্যায্য সমালোচনামূলক কিছু ছাপলে তারপর সরকার খুশি হবে—এ ধরনের কিছুও ছাপে। আমি বললাম, সেটা পত্রিকার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে হতে পারে। সে মানতে নারাজ। তার কথা হলো, আমি পাঠক, আমি সেটা কেন দেখতে যাব।

শীলার আরেকটা সমালোচনা হচ্ছে শিল্প–সাহিত্য থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে, প্রথম আলোর পছন্দের গুটিকয়েক মানুষ আছে। আমি বললাম, সেটা প্রায় সব পত্রিকার থাকে। তার বক্তব্য, এটা ভালো লাগে না দেখতে।

৩.

মনে হতে পারে, আমি আমার স্ত্রীর ঘাড়ে বন্দুক রাখলাম। আসলে তা নয়। কারণ, আগেই বলেছি, তার বক্তব্যের সঙ্গে আমি প্রায় শতভাগ একমত। তবে প্রথম আলোর আরও কিছু ভালো দিক আমি দেখি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শক্তিমত্তা। আমি নিজে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতাম একসময়। কোন কোন নোটারি পাবলিক কী দুর্নীতি করেন, সেটা প্রমাণের জন্য বঙ্গভবন বিক্রি করে দেওয়ার দলিল পর্যন্ত তৈরি করেছিলাম তরুণ বয়সে। ফলে এ দেশের পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দীনতা
আমাকে বিশেষভাবে মর্মাহত করে। পাশাপাশি প্রথম আলোয় সব সময় দেখেছি অসাধারণ সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। দেশে সাংবাদিকতাবিষয়ক যেকোনো পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথম আলোর প্রায় একচেটিয়া সাফল্য এর একটি প্রমাণ।

প্রথম আলোর আরেকটি শক্তিশালী দিক হচ্ছে, এতে সব সময় দেশের জন্য কেউ ভালো কিছু করলে, কোনো একটা আবিষ্কার বা অর্জন করলে তাকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা। যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো—খুব সত্যি মনে হয় অনেক সময়।

প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগ খুব শক্তিশালী। এর খেলাধুলা পাতা, সংস্কৃতি পাতা, নকশা বা অন্য আলো পাতা চমৎকার। তবে একসময় ইত্তেফাক–এ যেমন পাঠকের চিঠি দেখতাম, সে রকম চিঠিপত্র সম্পাদকীয় পাতায় থাকলে তা আরও অংশগ্রহণমূলক হতো। খেলাধুলা পাতায় আরও বৈচিত্র্য আনা সম্ভব বিবিসির মতো পাঠকদের জরিপ বা প্রেডিকশনে বহুভাবে জড়িত করে।

একটা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর ভাবা উচিত। সেটি হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণির বুদ্ধিজীবী–প্রীতি। বাংলাদেশে বহু পত্রিকায় বিএনপির কোনো সভায় কেউ অতিথি হিসেবে গেলে তাঁকে বিএনপিপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরও বহু ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত (যেমন তার নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত) ব্যক্তিদের উপস্থাপন করা হয় স্বতন্ত্র পরিচয়ে। এ দোষ থেকে
প্রথম আলো পুরোপুরি মুক্ত নয় সব সময়।

প্রথম আলোর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসনীয়। তবে আমার মতে, এখানে ইসলামি রাজনীতি করা দলগুলোর বিরুদ্ধে কখনো কখনো একধরনের বৈষম্য দেখা যায়।

নারীদের প্রতি প্রথম আলোর সম্মান আরেকটি শক্তিশালী দিক। আরও বহু ভালো দিক আছে প্রথম আলোর। না হলে কীভাবে এত বছর ধরে সম্মানের সঙ্গে শীর্ষে আছে পত্রিকাটি!

৪.

এ দেশে পত্রপত্রিকার স্বাধীনতার অবস্থা স্বস্তিকর নয় এখন। পত্রিকার ওপর খড়্গহস্ত হলে হয়রানিমূলক মামলা, বিজ্ঞাপন বন্ধে চাপ সৃষ্টি এবং অপপ্রচার করা হয়। বিএনপি আমলের সবচেয়ে বেশি চাপ এসেছে প্রথম আলোর প্রতি, আওয়ামী লীগের আমলেও তা–ই হচ্ছে। এটা প্রথম আলোর সাফল্য। অগণতান্ত্রিক আচরণ, দুর্নীতির প্রশ্রয়দান, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অসহিষ্ণুতা এখনকার সরকারগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এদের প্রতিপক্ষ যদি সব আমলে প্রথম আলো হয়, তাহলে তো বলতে হবে পত্রিকাটি সঠিক পথে আছে।

প্রথম আলো টিকে আছে, শীর্ষে আছে বহু পত্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, অনলাইনের আগ্রাসনের মুখে, করোনা আর মন্দার করাল গ্রাসের সময়। আরও বহু বছর এভাবে এবং আরও ভালোভাবে থাকুক প্রথম আলো

রাষ্ট্রের জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার এ সময়ে তাদের অনেক দায়িত্ব প্রথম আলোই পালন করছে। আমার মতে, শুধু এ কারণে হলেও তাকে টিকে থাকতে হবে দৃঢ়চিত্তে।


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক