টিকে আছে ধামের গান

বিষয়বস্তু, রঙ্গরস ও ব্যতিক্রমী উপস্থাপন শৈলীর কারণে আজও গ্রামের মানুষ আজও ভিড় করেন ধামের গানের আসরে। এ গান তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করা হয়।

আকাশ সংস্কৃতির দাপটে গ্রামবাংলার জনপদ মাতানো সব সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। লোকসংস্কৃতির অন্য সব শাখা যেখানে বিলুপ্তির পথে, সেখানে ‘ধামের গান’ আজও সগৌরবে টিকে আছে। বিশেষ করে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সাধারণ ঘটনা রঙ্গরসের মাধ্যমে পরিবেশনার কারণে ‘ধামের গান’ উত্তরাঞ্চলের সব শ্রেণির মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ধাম’ শব্দের অর্থ নিবাস বা আশ্রয়স্থল। এ আশ্রয়স্থল দেব–দেবীর। অর্থাৎ ধাম বলতে ধর্মীয় স্থানকে বোঝায়। আরাধ্য দেবতাকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ধামের গানের উৎপত্তি। এখন জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসানো হচ্ছে ধামের গানের আসর।

ধামের গানের আয়োজক ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধামের গান পরিবেশনার একটি ব্যতিক্রমী দিক হলো, ধামের গানের নির্দিষ্ট কোনো রচয়িতা নেই। পালা মৌখিক ও তাৎক্ষণিকভাবে রচিত। এখানে পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁরা পেশাদার অভিনয়শিল্পী নন, কেউ বর্গাচাষি, কেউ ভ্যানচালক আবার কেউ খেতমজুর। সমাজজীবনের ঘটনা সাধারণত স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় পরিবেশন করা হয়। ব্যবহার করা হয় দেশি বাদ্যযন্ত্র।

ধামের গান উঁচু চারকোনা মাটির তৈরি মঞ্চ বা আসরে পরিবেশন করা হয়। মঞ্চের চার কোনায় থাকে কলাগাছ বা জিগাগাছ দিয়ে তৈরি করা খুঁটি। আসরের মধ্যবর্তী জায়গায় শিল্পী ও কলাকুশলীরা বৃত্তাকারে বসে থাকেন। সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁরা বৃত্তাকার অংশের চারদিকে ফাঁকা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অভিনয় ও গীত পরিবেশন করেন।

সম্প্রতি সদর উপজেলার ঢোলারহাট এলাকার সন্ন্যাসীপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের পাশে বটগাছের তলায় চলছে ধামের গানের আসর। সেখানে দুই ফুট উঁচু করে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে চারকোনা মঞ্চ। মঞ্চ আলোকিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রঙের ইলেকট্রিক বাল্ব। সেই মঞ্চে পালা পরিবেশন করছে সদর উপজেলার হরিমানপুর গ্রামের ধামের দল। সেখানে চলছে ‘বাবার চোখের জল’ নামে পালা। দর্শকদের আকৃষ্ট করতে যাত্রার পাশাপাশি চলছে আধুনিক নাচ ও গান।

কাশিডাঙ্গী ধামের সভাপতি লক্ষ্মী মণ্ডল বলেন, ‘৫০ বছর হয়ে গেল এ ধামে গানের আয়োজন চলছে। এখন মানুষ মুঠোফোন ও টেলিভিশনে মেতে থাকলেও আমরা ধামের গান আয়োজন করে যাচ্ছি। সাড়া কেমন পাচ্ছি তা দেখতেই পাচ্ছেন।’

ধামের মঞ্চের পাশের একটি ঘরে সাজগোজ করছিলেন শিল্পী-কুশলীরা। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন পুরুষ নারীর সাজ নিতে ব্যস্ত। তাঁরা মুখে মেকআপ, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখার পর পরচুলার সঙ্গে পোশাক পরছেন। একটু পরেই এক পোঁটলা মুড়ি, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ নিয়ে এলেন আয়োজকরা। পরে একটি কাগজে সব মেখে এক এক করে দলের সদস্যদের মধে৵ বিতরণ করলেন রণজিৎ নামের এক ব্যক্তি। আর তা আয়েশের সঙ্গে খেতে লাগলেন তাঁরা।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের নাট্যশিল্পী মনতোষ কুমার দে জানান, ‘উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চিত্র গ্রামীণ নাট্যধারা ধামের গানের মাধ্যমে পরিবেশন করে। গ্রামের সহজ–সরল মানুষের যে জীবন, জীবনের নানা দিক, তা হাস্য–ব্যঙ্গরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন শিল্পীরা। অন্য যেসব বিনোদন মাধ্যম রয়েছে, সেগুলোকে ছেড়ে সাধারণ মানুষ ধামের গান উপভোগ করেন। টেলিভিশনের ধারাবাহিকগুলোরে চেয়েও ধামের গান তাঁদের কাছে আকর্ষণীয়। গ্রামের মানুষ তাঁদের নিজের কথা এখানে দেখতে পান বলেই ধামের গান তাঁদের কাছে এখনো আবেদন সৃষ্টি করে। তাই সুযোগ পেলেই তিনি ধামের গানের আসর উপভোগ করতে ছুটে যান।