যুদ্ধের মাঠ ছাড়ছি না

করোনা মহামারি আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। অতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে এক সুতোয় বেঁধেছে।
শ্বাসকষ্ট নিয়ে শিশুটিকে চট্টগ্রাম মেডকিলে কলজে হাসপাতালে নেওয়া হয়িেছল। এ সময় বড় মামা তাকে কোলে নিয়ে আর ছোট মামা সিলন্ডিার হাতে প্রাণপণ ছুটছলিনে শিশু ওয়ার্ডের দিক।করোনাকালে এই চিত্র ছিল সারা দেশেই।
ছবি: সৌরভ দাশ, ১৯ জুন ২০২০

করোনা নিয়ে প্রথম আলোয় আমার প্রথম প্রতিবেদন ছাপা হয় ২৮ জানুয়ারি। প্রথম আলো করোনা নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন ছেপেছিল ১৯ জানুয়ারি। সেই থেকে প্রতিদিনই করোনার প্রতিবেদন ছেপে চলেছে প্রথম আলো

মহামারির শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতি আমার খুব বেশি মনোযোগ ছিল না। আমার চোখ ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ), সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। আর নজর ছিল বিশ্বসেরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, বিজ্ঞান সাময়িকীর দিকে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ল্যানসেটের ছয়টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ আমি পেয়েছিলাম। সেসব বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছিল চীনের, বিশেষ করে উহান শহরের প্রথম দিকের রোগীদের নিয়ে। তিনটি প্রবন্ধের তথ্য মিলিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচের পাতায় বড় করে ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘মধ্যবয়সীদের ঝুঁকি বেশি’।

সোয়াইন ফ্লু, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু নিয়ে সংবাদ লেখার অভিজ্ঞতা আমার ছিল। বুঝতে পারছিলাম, নতুন ভাইরাসের ঘটনা অনেক বড় হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক পাতার সহকর্মীরা আমাকে নানাভাবে উসকে দিয়েছিলেন। বড় ঘটনা নিয়ে খবর করার লোভ সব প্রতিবেদকের থাকে, আমারও আছে। সব দিক সামাল দেওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন সহকর্মীকে আমার সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। এক সপ্তাহ পরে, এপ্রিলের শুরুতে একটি মিটিংয়ে সম্পাদক কাজের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। সেই দিনই মতি ভাই করোনা মোকাবিলার জন্য একটি দল গঠন করে দিলেন। আমিসহ সেই দলে ছিলেন রাজীব হাসান, আনোয়ার হোসেন, রিয়াদুল করিম ও সামছুর রহমান। এক দিন পরই যুক্ত হলেন টিপু সুলতান। তবে শুরু থেকে অফিসের সব জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ সহকর্মী তথ্য দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, প্রশ্ন করে আমাকে বিপুলভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন।

নিজে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকির বিষয় সব সময় আমার মাথায় ছিল। অন্য গণমাধ্যমের স্বাস্থ্যবিটের সহকর্মী নিয়েও আমার দুশ্চিন্তা ছিল। নিজেদের সুরক্ষা ও করণীয় নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম। এতে যুক্ত ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। কর্মশালায় সহকর্মীদের আমি বলেছিলাম, অলিম্পিকের চেয়ে বড় ঘটনা নিয়ে আমরা খবর লিখছি। ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদক যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যে ঘটনা নিয়ে সংবাদ লিখছেন, ঢাকায় থেকে আপনিও একই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। সুতরাং মহামারির বিজ্ঞান বুঝতে হবে, কঠিন পরিশ্রম করতে হবে, নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

সুন্দর কিছু শব্দের সঙ্গে পরিচয় হলো: কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে শনাক্ত করা), আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ), সোশ্যাল ডিস্টেনসিং (নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা), লকডাউন (অবরুদ্ধ করা), ট্রায়েজ (একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সংক্রমিত ও অসংক্রমিত ব্যক্তিদের পৃথক করা), ইনফেকশন রেট (সংক্রমণ হার), হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা (রোগীকে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করা প্রযুক্তি), পালস অক্সিমিটার (রক্তে দ্রবীভূত অক্সিজেন পরিমাপ করার যন্ত্র), হ্যাপি হাইপোক্সিয়া (অনেকে বুঝতে পারেন না যে তিনি অক্সিজেন–স্বল্পতায় ভুগছেন), লং কোভিড (দীর্ঘ সময় কোভিডের লক্ষণ বজায় থাকা), ইনফোডেমিক (বিপুল পরিমাণ তথ্যের অবাধ প্রবাহ)। আমরা যেসব শব্দ ব্যবহার করছি, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটনের সাংবাদিকেরা সেগুলোই ব্যবহার করছেন। তাঁরা এবং আমরা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ নিয়ে লিখছি।

এপ্রিলের শুরুতে পরিচিত একজন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কেবিনের চেষ্টা করেও পাননি, সাধারণ ওয়ার্ডে ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হতো। তিনি ওয়ার্ডের ভেতরের বর্ণনা দিতেন, চিকিৎসক-নার্সদের দায়িত্ব পালনের কথা বলতেন। একদিন তিনি ওয়ার্ডে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। মারাত্মক ছিল সেই ঘটনা।

খিলগাঁও-তালতলা কবরস্থানে করোনায় মৃতদের কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শুরুতে এলাকার কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করেছিলেন। পরে মেনে নেন। কবরস্থানের পাশেই একজন সাংবাদিকের বাসা। লাশ এলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা তিনি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আমি তাঁকে ডায়েরিতে ঘটনা লিখে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কোনো কোনো দিন গভীর রাতে আমাকে ফোন করে ঘটনার বর্ণনা দিতেন। আমি এক দুপুরে কবরস্থানে গিয়েছিলাম।

কাজে বিপুল উৎসাহ ছিল। আনন্দেরও ঘাটতি ছিল না। বুঝতে পারছিলাম সংবাদ ব্যবস্থাপকেরা, বিশেষ করে সম্পাদক অসন্তুষ্ট নন। ক্লান্তি নেই। ছুটি নেই। প্রতিদিন কাজ। ২৪ ঘণ্টার সাংবাদিকতা। প্রতিদিন ভয়ের খবর, মন খারাপ হওয়ার তথ্য। নতুন নতুন দুঃসংবাদ। ১৭ এপ্রিল শওকত হোসেন মাসুমের নমুনা নিলেন আইইডিসিআরের কর্মীরা। ১৯ এপ্রিল তাঁর করোনা শনাক্ত হলো। পরদিন ভর্তি হলেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অনেকেরই মন খারাপ হলো। তার এক দিন পর থেকে আমরা ‘হোম অফিস’ শুরু করলাম।

টিম যথাযথ হলে ‘টিমওয়ার্ক’ কতটা কার্যকর হতে পারে, তা বুঝলাম হোম অফিসের অভিজ্ঞতায়। সম্পাদক মতি ভাই নিয়মিত নির্দেশনা দিতেন: শব্দ ব্যবহারে সংযম দেখাতে হবে, শিরোনাম মার্জিত হতে হবে ইত্যাদি। মাথা ঠিক রাখতে হবে, যেন আমার বা প্রথম আলোর কারণে হাসপাতাল, চিকিৎসকের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট না হয়। আমরা প্রায় প্রতিদিন দুপুরে হোয়াটসঅ্যাপে মিটিং করতাম। আমি প্রতিবেদন লিখেই খালাস। শুধু ভাবতাম রাজীব, টিপু, সাঈদ ও হাসনাত বাড়িতে বসে কীভাবে কাগজটি বের করছেন। রাজীব আর আমার মধ্যে এই বোঝাপড়া ছিল যে এক ইস্যুতে একই সঙ্গে দুজন উত্তেজনায় জড়াব না। একদিন আমার লেখা এত খারাপ হলো যে টিপু বললেন, রিপোর্ট যদি রিয়াদ বা আদিলের লেখা হতো তা হলে...। অন্য একদিন সাঈদের ওপর এতটাই খারাপ ব্যবহার করলাম যে আমার স্ত্রীর নির্দেশে সাঈদের কাছে মাফ চাইলাম। মনে পড়ে, ঢাকা মেডিকেল নিয়ে একটি প্রতিবেদন রাত ১২ পর্যন্ত মোট পাঁচবার বদলাতে বলেছিলেন মতি ভাই।

স্বাস্থ্য আমার কাজের জায়গা। কাজের সুবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক-বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। মহামারির কারণে নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, কারও কারও সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদক হওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় জনস্বাস্থ্যবিদ, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, অণুজীববিজ্ঞানী, টিকাবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, ওষুধবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি, পেয়ে চলেছি। ‘হোম অফিস’ চলার সময় প্রতিদিন এঁদের দু–চারজনের সঙ্গে মুঠোফোনে লম্বা আলোচনা হতো। এখন তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

কিছু ঘটনায় মানুষ আঁতকে উঠেছিল। খবর বেরিয়েছিল, হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ইতালিতে অপেক্ষাকৃত কম প্রবীণেরা চিকিৎসায় অগ্রাধিকার পাচ্ছেন, ইউরোপের বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুহার বেশি। মন ভেঙে যাওয়ার খবর এ দেশের সাংবাদিকদেরও লিখতে হয়েছে। ঢাকায় চিকিৎসক মেয়ে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন, ভর্তি করাতে পারেননি। সন্তানেরা অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছেন, এমন সংবাদ ছাপা হলো। জ্ঞানে, সম্পদে ও মানবিকতায় মানুষ কত পিছিয়ে আছে, করোনাকাল তার সাক্ষী।

মহামারি হচ্ছে ঘটনার সাগর। বাসায় থাকা আমার স্বভাব নয়। ঈদের ছুটি চলছে। বেশ জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা। ২৬ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মীরা নমুনা নিলেন। ২৭ মে রাতে আইইডিসিআরের পরিচালক ফোন করে জানালেন, আমাকে করোনায় ধরেছে। কাজ বন্ধ, বাসায় আইসোলেশনে। আমার স্ত্রী ও ছেলের মানসিক চাপ বাড়ল মারাত্মকভাবে। ভেজা চোখ নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। আপ্রাণ চেষ্টা ছিল মায়ের কান পর্যন্ত যেন খবরটা না পৌঁছায়। খাওয়া, বই পড়া আর উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখা চলল। ৬ জুন রাতে জানলাম আমি নেগেটিভ। ৮ জুন সংক্রমণের তিন মাসের পর্যালোচনা নিয়ে আমার লেখা প্রধান শিরোনাম হলো।

করোনা মহামারি আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। অতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এর স্বাস্থ্যের দিকটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক দিক। যুক্ত হয়েছে রাজনীতি-কূটনীতি।

বিজ্ঞানীরা গত ডিসেম্বর থেকে নভেল করোনাভাইরাসের চরিত্র, গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। প্রতিদিন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জুতসই উপায় বা প্রযুক্তি এখনো কারও হাতে আসেনি। একটি কার্যকর ও নিরাপদ টিকার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব। এত বড় ঘটনা অনুসরণ করা রীতিমতো যুদ্ধের মতো। শিগগিরই করোনা দূর হচ্ছে না। যুদ্ধের মাঠও ছাড়ছি না।

শিশির মোড়ল: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি