হোম অফিসের কারিগর

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অন্যতম অংশীদার হলেন আমাদের সংবাদকর্মীরা, যাঁদের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছাড়া পুরো বিষয়টি এতটা পরিপূর্ণতা পেত না

২০ এপ্রিল, সকাল ১০টা

সহকর্মী ফাতহী রহমানের ফোন, ‘ভাইয়া, অনলাইনের সবাইকে বাসায় চলে যেতে বলেছে। আমরা কী করব?’

‘তোমরা থাকো, আমি আসছি।’

তারপর আরও কয়েকটি ফোন পেয়ে দ্রুত অফিসে আসি। বোর্ডরুমে জরুরি সভা, তখনো ভাবতে পারিনি কী হতে যাচ্ছে। সাজ্জাদ ভাই বার কয়েক জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চাইলেন, এটি আদৌ সম্ভব কি না। ‘না’ বলার কোনো উপায় নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ২১ এপ্রিল থেকেই পুরো অফিসের সবাই বাসা থেকে কাজ করবেন। রিপোর্টাররা অফিসের বাইরে থেকে অনেক আগে থেকেই কাজ করে পাঠান, সমস্যা নেই। কিন্তু ডেস্ক ও পাতা মেকআপের কাজ হবে বাসা থেকে, সেটা কোনো দিন ভাবনাতেই আসেনি।

হাতে যেমন সময় ছিল না, তেমনি ছিল না বিশেষ কোনো প্রস্তুতি। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ, রাউটারসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ ছিল। দুপুরে সব সংবাদকর্মীকে বলা হয় যে তাঁরা যেন আইটি বিভাগ থেকে যা দরকার তা নিয়ে বাসায় চলে যান। আমাদের হাতে থাকা ল্যাপটপের তালিকা করে আরও ভয় পেয়ে গেলাম। যদিও তার প্রায় ১০ দিন আগে থেকেই কিছু ল্যাপটপ কেনার কথা হচ্ছিল, কিন্তু হাতে তখনো পাইনি। এমন অনেকেই ছিলেন, যাঁরা বাসায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না এবং তখনকার বাস্তবতায় নতুন সংযোগ নেওয়াটাও সম্ভব ছিল না, এটা আরও ভয়ের কারণ।

২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় নতুন ল্যাপটপগুলো হাতে পেয়ে এক প্রকার স্বস্তি পেলাম। কিন্তু তারপরও সেদিন পুরোপুরিভাবে সবাইকে প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ ও আনুষঙ্গিক সহায়তা দেওয়া যায়নি। সারা রাত সবাই মিলেই প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ প্রস্তুত করেছি। পরদিন দুপুর ১২টার মধ্যে সবাইকে প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া শেষ করার তাগাদা ছিল। কারণ, তিনটা থেকেই আবার পরদিনের কাজ শুরু। এর আগে অনেকবার অফিসে কাজে রাতে থেকেছি, টানা প্রায় ৪৮ ঘণ্টাও থেকেছি, কিন্তু সেদিন রাতটা অন্য রকমের উৎকণ্ঠায় কেটেছে। প্রথম দিন মোটামুটি সবাই বাসা থেকে কাজ করলেও কয়েকজন অফিসে থেকেই করেছেন। মূল পরীক্ষা আসলে শুরু হয়েছে তার পরের দিন ২১ এপ্রিল থেকে।

পুরো পত্রিকার ডামি থেকে শুরু করে ছাপাখানায় যাওয়া পর্যন্ত সব কাজ হয়েছে বাসা থেকেই। সকাল আটটায় অনলাইন দিয়ে শুরু করে রাতের পত্রিকার প্রিন্ট হওয়া পর্যন্ত আমরা পালাক্রমে সবাই কাজের মধ্যে ছিলাম। সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে অফিসে গিয়েছি প্রায় প্রতিদিন, কিছু সহকর্মীর বাসায়ও গিয়েছি আমরা প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে। অফিসে কেউ ছিলেন না বলে সন্ধ্যার পরে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হতো, ভাগ্য ভালো ছিল যে গ্রাফিক্স বিভাগের জয়দেব সরকার ও নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন। না হলে আসলেই সন্ধ্যার পরে অফিসে থাকাটাও মুশকিল ছিল। কোনো দিন ঝড় বা বৃষ্টি হলে আলাদা আতঙ্কে থাকতাম, এই বুঝি কেউ ফোন করে বলেন যে ‘বাসায় ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ নেই, কাজ করতে পারছি না।’

এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা প্রশিক্ষণ ছিল না ঠিকই, তবু আমরা পেরেছি। আমাদের দলের বেশির ভাগ কর্মী ছিলেন একেবারে নতুন। তারপরও তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, আমরা সবার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। তবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অন্যতম অংশীদার হলেন আমাদের সংবাদকর্মীরা, যাঁদের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছাড়া পুরো বিষয়টি এতটা পরিপূর্ণতা পেত না। সবাই সবার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বলেই এটা সম্ভব ছিল। মাঝখানে দুটি ঈদ পার হয়েছে, কিন্তু যেদিন ‘হোম অফিস’ ছেড়ে ‘আসল অফিস’ পুনরায় শুরু হলো, আমার কাছে সেদিনের মতো আনন্দ বোধ হয় আর কিছু ছিল না।

আরিফ রব্বানী: ব্যবস্থাপক, এন্টারপ্রাইজ অ্যাপলিকেশনস, আইটি বিভাগ