অকালে অচল, বিক্রি লোহালক্কড়ের দামে

১৫৩টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রির দরপত্র ডেকেছে বিআরটিসি। আরও ১০১টি অমেরামতযোগ্য তালিকায়।

  • বিক্রির জন্য রাখার বাইরে বিআরটিসির বহরে বাস আছে ১ হাজার ৬৫০টি।

  • মোট বাসের মধ্যে সচল ১ হাজার ২৫১টি, অচল ৩৯৯টি।

বিআরটিসির লক্কড়ঝক্কড় অকেজো বাস ফেলে রাখা হয়েছে রাজধানীর কল্যাণপুর বাস ডিপোতে। ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

দক্ষিণ কোরিয়ার দায়্যু কোম্পানির কাছ থেকে ২০১১ সালের দিকে ২৫৫টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ও সাধারণ (নন-এসি) বাস কেনে সরকারের পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। বাসগুলো সড়কে অন্তত ১৫ বছর চলার কথা। কিন্তু ১০ বছর না যেতেই ৫টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে সংস্থাটি। আরও ৩০টি বাস একইভাবে বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।

দায়্যুর বাসসহ সব মিলিয়ে ১৫৩টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে বিআরটিসি। সংস্থাটির সূত্র বলছে, দায়্যু কোম্পানির অচল বাসগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে অবস্থাভেদে প্রতিটি ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। তবে সংস্থাটি যে দাম নির্ধারণ করে, বরাবরই তার চেয়ে অনেক কমে পাওয়া যায়। এবারও কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, দায়্যু কোম্পানির বাসের দাম প্রতিটি এক-দেড় লাখ টাকার বেশি পাওয়া যাবে না।

বিআরটিসি সূত্র জানিয়েছে, কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ঋণ নিয়ে বাসগুলো কেনা হয়েছিল। করসহ প্রতিটি বাসের দাম পড়ে ধরনভেদে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। সেই বাসই এখন লোহার দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। বিআরটিসি সূত্র জানায়, কোরিয়া থেকেই বাস কিনতে হবে—এমন শর্তে ঋণ নেওয়া হয়েছিল। রাস্তায় নামার পর থেকেই বাসগুলোতে নানা ত্রুটি দেখা দিতে শুরু করে। ২০১৬ সাল নাগাদ অর্ধেক বাস অচল হয়ে যায়। বিআরটিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, একেকটি বাসে ইঞ্জিনসহ ২০টির মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র থাকে। দায়্যু কোম্পানির বেশির ভাগ বাসে এখন অর্ধেক যন্ত্র বিকল।

বিআরটিসির কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সংস্থাটির বাস না টেকার কিছু কারণ পাওয়া যায়। তাঁরা বলছেন, বাসের বেশির ভাগই কেনা হয়েছে বিদেশি ঋণে। যে দেশ ঋণ দেয়, সেই দেশ থেকেই বাস কিনতে হয়। ফলে দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দামে কেনার সুযোগ থাকে না। নিম্নমানের বাস আমদানির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এর বাইরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মেরামত ও যন্ত্রাংশ কেনায় দুর্নীতি বাস না টেকার অন্যতম কারণ।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের শৈশব, কৈশোর ও বৃদ্ধ—একেক সময় একেক ধরনের যত্ন দরকার। বিআরটিসির বাসেরও একই রকম যত্ন করতে হয়। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে হয়ে ওঠে না। তিনি জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। অচল হয়ে যাওয়া ১০০ বাস এর মধ্যে মেরামত করে চালু করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাসের আয়ুষ্কাল বাড়বে।

বিক্রির প্রক্রিয়ায় প্রথমে বিআরটিসির ডিপোগুলোতে দীর্ঘদিন বিকল থাকা বাসের তালিকা করা হয়, যাকে বলা হয় বিয়ন্ড ইকোনমিক রিপেয়ার (বিইআর) তালিকা। যেসব বাস মেরামত করে চালানো অলাভজনক বলে গণ্য হয়, সেগুলোকে এই তালিকায় ফেলা হয়। বিআরটিসির একটি কমিটি অমেরামতযোগ্য বাস বিক্রির অনুমোদন দেয়।

কম দামে বাস কিনে বেসরকারি খাতের মালিকেরা বেশি দিন চালাতে পারছেন। বিআরটিসি কেন পারছে না, এ প্রশ্নের উত্তর দরকার।
মোয়াজ্জেম হোসেন, অধ্যাপক, বুয়েট

বিআরটিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২৮৭টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ১৮৭টি বাস বিক্রি হয়েছে। অবিক্রীত ১০০টির সঙ্গে গত জুনে যুক্ত হয়েছে আরও ৫৩টি। এই ১৫৩টি বাস গত ২৬ আগস্ট বিক্রির জন্য দরপত্র ডেকেছে বিআরটিসি। তালিকায় ২০১১ সালে কেনা চীনের ইয়াংশি কোম্পানির ২টি, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কেনা চীনের ফাও কোম্পানির ২১টি, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে কেনা ভারতের টাটা কোম্পানির ৬৯টি ও ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কেনা ভারতের অশোক লেল্যান্ডের ১৮টি দ্বিতল বাস এবং ১১টি মিনিবাস রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বাস পাঁচ-ছয় বছর ধরে ডিপোতে পড়ে আছে।

এদিকে বিআরটিসি নতুন করে ১০১টি বাস ‘অমেরামতযোগ্য’ তালিকায় যুক্ত করেছে। যদিও বিক্রির সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি বলে সংস্থাটির সূত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ গত আগস্ট পর্যন্ত হিসাবে, লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রির জন্য রাখা বাদে বর্তমানে বিআরটিসির বহরে মোট বাস আছে ১ হাজার ৬৫০টি। এর মধ্যে সচল ১ হাজার ২৫১টি, অচল ৩৯৯টি।

‘কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি বাসের পেছনে কত খরচ, আয় কত, পুঁজি উঠছে কি না—এসব জানা থাকা দরকার। কিন্তু বিআরটিসির এই ধরনের ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। ফলে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। তিনি বলেন, ‘কম দামে বাস কিনে বেসরকারি খাতের মালিকেরা বেশি দিন চালাতে পারছেন। বিআরটিসি কেন পারছে না, এ প্রশ্নের উত্তর দরকার। নইলে বিআরটিসিতে শুধু টাকা ঢালতেই থাকব, ফল পাওয়া যাবে না।’