অদম্য মেধাবীরা শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস

অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা
অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা

তারা এখন প্রেরণার উৎস। অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রতিকূলতার যাবতীয় অন্তরায় অতিক্রম করে অর্জন করছে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। তাই তারা অদম্য। প্রথম আলো তাদের ভূষিত করেছে ‘অদম্য মেধাবী’ অভিধায়। সেই অদম্য মেধাবীদের সংবর্ধনা দেওয়া হলো আজ বৃহস্পতিবার। 

সংবর্ধনার জবাবে ওরা জীবনের অনেক বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানিয়েছে। জানিয়ে গেছে দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি। অনুষ্ঠানের উপস্থিত বিশিষ্টজনরা অদম্য মেধাবীদের সব শিক্ষার্থীর প্রেরণার উৎস হিসেবে উল্লেখ করেন।
তাদের কেউ এসেছে সেই নাচোলের প্রত্যন্ত সাঁওতাল পাড়া থেকে, কেউ সুন্দরবন লাগোয়া মাদার নদীর চর থেকে। কারও চোখে আলো নেই, কিন্তু হৃদয় ভরে আছে আলোয় আলোয়। মাদার নদীর চরের আজিবার রহমান বলছিল— মাথা গোঁজার একরত্তি জায়গাটুকুও তাদের নেই। বাবার পেশা মাছ ধরা। শৈশব থেকেই বাবার সঙ্গে নৌকায় জাল নিয়ে গেছে সে মাছ ধরতে। জালের সঙ্গে আরও একটি জিনিস ছিল। বই। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় সব কটি বিষয়ে এ প্লাস (গোল্ডেন) পেয়ে সে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়া।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিন্তা খাতুনের বাবা অসুস্থ। মা গৃহকর্মী। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা পর্যন্ত ছিল না তার। টাকা জোগাড় করে দিয়েছে এক বান্ধবী। চিন্তা জিপিএ পাঁচ পেয়েছে এবার। সে হতে চায় চিকিৎসক। শিক্ষক হতে চায় সাঁওতাল পাড়ার মনোতোষ হেমব্রেম। ক্ষেতে দিনমজুরির কাজ করে এসএসসিতে জিপিএ পাঁচ পেয়েছিল। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোকাদ্দেস জানিয়েছে সে হবে আইনজীবী। এ ভাবেই গতকাল বৃহস্পতিবার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নিজেদের স্বপ্ন আর পেরিয়ে আসা জীবনের কঠিন সংগ্রামের কথা অসংকোচে তুলে ধরছিল অদম্য মেধাবীরা। তাদের জীবনসংগ্রাম ও অর্জিত সাফল্যের কথা শুনতে শুনতে অতিথিদের অনেকেরই চোখ ভিজে ওঠে।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা-২০১৫ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে অদম্য মেধাবী এইচএসসি উত্তীর্ণরা। ছবি: জাহিদুল করিম
ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা-২০১৫ অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে অদম্য মেধাবী এইচএসসি উত্তীর্ণরা। ছবি: জাহিদুল করিম

প্রথম আলো কার্যালয় সিএ ভবন মিলনায়তনে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবীদের এই সংবর্ধনার আয়োজন করে। এবার এসএসসিতে জিপিএ পাঁচ পাওয়া ৫০ জন এবং আগের অর্থসহায়তা প্রাপ্তদের মধ্যে যারা সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায়, তেমন ৩০ জনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই ৩০ জন যত দূর পর্যন্ত পড়তে চান সে পর্যন্ত তাদের মাসিক ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হবে। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ ফজলে এলাহীর অর্থায়নে ৫ জনসহ মোট ৮৫ জনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এসএসসির কৃতিরা পাবেন এইচএসসি পর্যন্ত বৃত্তি।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অদম্য মেধাবীদের পদক পরিয়ে দেন। তিনি বলেন, অদম্য মেধাবীরা সকল শিক্ষার্থীর প্রেরণার উৎস। তিনি বলেন, কেবল পড়া-লেখায় ভালো করলে হবে না। তোমাদের ভালো মানুষ হতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ, সততা ও দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।
সূচনা বক্তব্যে সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়াসহ প্রথম আলো ট্রাস্টের বিভিন্ন কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেন। ১৯৯৯ সাল থেকে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শিক্ষাসহায়তা দেওয়া শুরু হয়। নিয়মিত ভাবে অর্থসহায়তা দেওয়া শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে। তখন আমেরিকান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ম্যাডোনা গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন। এরপর ২০১০ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংক যুক্ত হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্টের এই কার্যক্রমে।
এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারের প্রথম নারী যিনি স্নাতক পর্যায়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়ছেন, প্রতিবছর এ রকম ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ট্রান্সকম সহায়তা করে। ২০১২ সাল থেকে এই বৃত্তির প্রচলন হয়। বর্তমানে ৪০ জন নারী এই বৃত্তি পাচ্ছেন। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ৫৮২ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে নিয়মিত বৃত্তি পাচ্ছে ২৯৩ জন।

চলছে অদম্য মেধাবীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ। ছবি: জাহিদুল করিম
চলছে অদম্য মেধাবীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ। ছবি: জাহিদুল করিম

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল প্রথম আলো সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হকের উপস্থাপনায়। শুরুতে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যানন্দনের শিল্পীরা।
ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মামদুদুর রশিদ বলেন প্রথম আলোর এই ভালো কাজটির সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তাদের আনন্দের কথা জানান। অদম্যদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা লেখাপড়া চালিয়ে যাও। ভালো ফল করো। আমরা তোমাদের পাশে থাকব। অর্থের অভাবে আর তোমাদের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার ভয় থাকবে না।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সামন্তলাল সেন অদম্যদের দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসার পরামর্শ দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাল্যবিবাহ ও মাদককে ‘না’ বালার অঙ্গীকার করান। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সব ধরনের বই পড়তে উৎসাহিত করেন। জীবনে কোনো প্রতিকূলতার কাছে মাথা নত না করার প্রেরণা দেন। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক পারভিন হাসান বলেন, তোমরা লড়াই করে সফল হয়েছে। এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে। অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমি‌উনিকেশন অ্যান্ড সার্ভিস কোয়ালিটি জারা জাবীন মাহবুব, প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আজিজা আহমেদ ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে অদম্যদের অনুপ্রেরণার দিয়ে ‘নিধুয়া পাথারে’গেয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। ইবরার টিপু শুনিয়েছেন ‘স্বপ্নগুলো চোখের ভেতর’। এস আই টুটুল গেয়েছেন ‘ রাতের আকাশের নিশ্চুপ সাক্ষী দূরের ঐ ধ্রুবতারা’এবং ‘চাঁদনী পশর রাতে’। সবাইকে নিয়ে মাহামুদুজ্জামান বাবুর গাওয়া ‘আমি বাংলার গান গাই’ গানটি দিয়ে শেষ হয় আনন্দঘন এই আয়োজন।